দক্ষিণ এশিয়ায় গত পাঁচ দশকে নগরায়ন সবচেয়ে বেশি হয়েছে বাংলাদেশে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পর থেকে নগরায়নের এই ধারায় নগরে বসবাসকারী জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে গড়ে বছরে ৬ শতাংশ হারে। এই সঙ্গে নগরে দরিদ্র জনসংখ্যাও বেড়েছে। এ কথা বলাই বাহুল্য, উন্নয়ন প্রক্রিয়ার একটি অবধারিত বৈশিষ্ট্য হলো নগরায়ন। আর নগরায়ন হলে নগরে শিল্পায়ন হয়, কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়। সেই সুবাদে নগরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। এটাও লক্ষ্যযোগ্য, নগরে কাজের সুযোগ থাকায় গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষ নগরে ছুটে আসে এবং কোনো না কোনো একটা কাজ জুটিয়ে নিয়ে নগরেই স্থায়ী হয়ে যায়। যেহেতু তাদের আর্থিক সঙ্গতি কম সুতরাং তারা বসবাসের জন্য বেছে নেয় বস্তি। বিস্তারিত তথ্য-উপাত্তের উল্লেখ না করেও বলা যায়, স্বাধীনতার পর রাজধানী ঢাকায় লোকসংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। স্বাধীনতার আগে এই নগরে বসবাস ছিল কয়েক লাখ লোকের। এখন তা দেড় কোটি-পৌনে দুই কোটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে নগরের ব্যাপক ও অবিশ্বাস্য বিস্তৃতি ঘটেছে। অসংখ্য শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। নানা ধরনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ায় বানের পানির মতো এই নগরে মানুষ এসেছে এবং বসতি গড়ে তুলেছে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, প্রতিদিন কয়েক হাজার লোক এই নগরে আসছে এবং থেকে যাচ্ছে। বছরে অন্তত ৬-৭ লাখ লোক এভাবে স্থায়ী হচ্ছে। তাদের বসবাসের জন্য বস্তিতই ভরসা। দেশে যত বস্তি আছে তার ৩৬ শতাংশই রাজধানীতে অবস্থিত।
দেশের মোট জিডিপির ৬০ শতাংশ আসে নগর থেকে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা নগরের অবদান ৩৬ শতাংশ। কিন্তু এই প্রাপ্তির বিপরীতে নগরগুলোকে বিশেষত ঢাকা নগরকে ব্যাপক খেসারত গুনতে হচ্ছে। যানজটসহ নানা প্রকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি এবং সমস্যার শিকার হতে হচ্ছে। সরকারি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে একজন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, কেবলমাত্র যানজটের কারণে রাজধানীতে বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এর বাইরে প্রতিদিন কর্মসময় নষ্ট হয় ৩২ লাখ ঘণ্টা। এর অর্থমূল্য কত হতে পারে, সেটা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। নগরে দারিদ্র্য বৃদ্ধির একটা বড় কারণ বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের বসবাস। বস্তিতে লাখ লাখ মানুষের বসবাসের কারণে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিশেষ করে গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের একটা বড় অংশ সেখানে চলে যাচ্ছে। প্রকৃত গ্রাহক বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে নানা সামাজিক সমস্যা, অপরাধ, মাদক কারবার ইত্যাদি বাড়ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা বসবাস অযোগ্য নগরের তালিকায় নিকৃষ্টতম স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা নগরের চার পাশের চার নদী দূষণের দিক দিয়ে সবচেয়ে অবনত অবস্থায় পৌঁছেছে। অন্য এক তথ্যে জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় নদী দূষণ হয়েছে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। প্রতিদিন ঢাকার হাজার হাজার টন বর্জ্য এর চার পাশের নদীগুলোতে অবিরাম পতিত হচ্ছে। ঢাকার বায়ুতে সিসার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও রয়েছে ক্ষতিকর উপাদান। নিঃশ্বাসে ‘বিষ’ গ্রহণের কারণে ঢাকার জনস্বাস্থ্যও মারাত্মক হুমকির শিকার।
এই বিপজ্জনক ও দুর্ঘট পরিস্থিতির আশু অবসান কাম্য হলেও তেমন কোনো সুখবর নেই। রাজধানীকে বসবাস উপযোগী, নিরাপদ, নাগরিক কল্যাণদায়ী এবং সৌন্দর্যম-িত ও আকর্ষণীয় করতে হলে অবশ্যই ট্যানারি, গার্মেন্টসহ সব ধরনের কলকারখানা স্থানান্তর করতে হবে, বস্তি সরাতে হবে, রাস্তাঘাট থেকে অতিরিক্ত যানবাহন বিশেষ করে রিকশা উঠিয়ে দিতে হবে। রাজধানীতে সরকারি-বেসরকারি অফিস ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কেন্দ্রীয় কার্যালয় থাকায় যে রাজধানীমুখিতা বিদ্যমান, বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে তা কমানো যেতে পারে। সেদিকেও গুরুত্বের সঙ্গে দৃষ্টি দিতে হবে। রাজধানীসহ দেশের সব নগরকে বসবাসযোগ্য এবং অধিকতর কার্যকর অবস্থায় নিয়ে আসতে হলে এখনই গভীরভাবে ভাবনাচিন্তা করতে হবে এবং উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন