দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন থাকার পরও চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েই ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল কৌশল অবলম্বন করছেন তারা। তার মধ্যে সবার আগে রাতের অন্ধকারকে বেছে নিয়েছেন নিম্নআয়ের মানুষেরা। লকডাউন বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রাকজধানীতে অবস্থান করা নিম্নআয়ের এসব মানুষদের শেষ গ্রুপটিও এখন যেকোনো উপায়ে গ্রামে যেতে মরিয়া।
লকডাউনের মধ্যে দিনের বেলায় ঢাকার রাস্তাঘাটে কয়েক স্তরে কড়াকড়ি চলে। তবে রাত যত গভীর হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদারকিও শিথিল হয়ে আসে। রাজধানীর মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের তল্লাশি রাত ১১টার পরে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। আর এসব কারণেই ঢাকা ছাড়তে রাতে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ভিড় বাড়ে তাদের।
এসব ক্ষেত্রে তাদের মূল ভরসা রাজধানীর কাঁচাবাজারে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পণ্য নিয়ে আসা ট্রাক ও পিকআপ। এসব ট্রাক ও ছোট ছোট যানবাহন ফিরতি পথে নানা কৌশলে যাত্রী নিয়ে ফিরছেন। আর এমন আশায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী ও গাবতলীতে জড়ো হন তারা। নিম্নআয়ের এসব মানুষেরা সবজির ট্রাকে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে পার হয়ে যান। মাঝেমধ্যে কিছু লোক বাধা মুখে পড়লেও পরে ঠিকই ম্যানেজ করে নেন তারা। একইভাবে গ্রাম থেকে ফিরছেনও অনেকে।
আলমগীর নামে একজন যাত্রী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, তিনি একটি দোকানের কর্মচারী। কঠোর লকডাউনে মার্কেট দোকান বন্ধ আছে। মনে করেছিলাম এক সাপ্তাহ লকডাউনের পর দোকান খুলবে এখন দেখছি লকডাউন আরো ১ সাপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে। দোকান বন্ধ থাকলে মালিকও তাদের বেতন দিবে না। তাহলে ঢাকায় বসে কি খাব? তাই বাধ্য হয়েই গ্রামে ফিরতে হচ্ছে তাকে।
গত রোববার রাত ১০টায় নারায়নগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোডের শিবু মার্কেট এলাকায় একটি পিকআপ যোগে একটি পরিবারকে নিজ গন্তব্যে যেতে দেখা যায়। জানতে চাওয়া হলে তিনি দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, লকডাউনের কারণে দিনের বেলায় সড়কে পুলিশের কড়াকড়ির কারণেই রাতেই বেলাই রওনা করেছি। রাতে চলাচলে কোন সমস্যা নেই বলেও তিনি জানান। নাম জানতেই বলল বাশার।
এভাবে ঠাসাঠাসি করে মাইক্রোবাস, কার বা পিকআপে মানুষ যাওয়ায় সংক্রমণ আরও বাড়ছে বলে অপেক্ষমাণ যাত্রীদেও কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। তাদেরই একজন মনোয়ার হোসেন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, প্রাইভেটে-মাইক্রোতে মানুষ যেভাবে ঠাসাঠাসি করে যাচ্ছে এতে সংক্রমণ ঝুঁকি বেশি হচ্ছে। লকডাউনে শুধু পণ্যবাহী ও জরুরি যানবাহন চলাচলের কথা থাকলেও সড়কে ব্যক্তিগত গাড়িও অহরহ চলাচল করতে পারছে। পুলিশও তাদেরকে কিছু বলছে না।
তবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে এভাবে ঠাসাঠাসি করে গণপরিবহন চলাচল করার কারণেই করোনা এখন বড় শহর থেকে জেলা শহর হয়ে গ্রামের সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণের ভয়াবহতার কারণে লকডাউনের মতো কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। অথচ এসব ছোট ছোট গাড়িতে যেভাবে যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে তাতে বির্পযয় হতে পারে
এছাড়া দিনেও ছোট ছোট যানের দাপট আগের তুলনায় বেড়েছে মহাসড়কগুলোতে। ফলে কম হলেও দিনের বেলাও থেমে নেই ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা। গতকাল সকালে রাস্তার ভোগান্তি, বাড়তি খরচের বোঝা মাথায় নিয়েই বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে ও গাবতলী এলাকা দিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে দেখা গেছে। এর আগে গাবতলী কিংবা সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে এসব গাড়ি পাওয়া গেলেও এবারের চলমান লকডাউনের কারণে যাত্রীকে কিছুটা হেঁটে আমিনবাজার ও কাঁচপুরে গিয়ে গাড়িতে উঠতে হচ্ছে। আবার একইভাবে ঢাকায় ফিরছেন কেউ কেউ। এসব বাহনে স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই ঠাসাঠাসি করে বসে বাড়ি ফিরছেন তারা। অথচ শুধু পণ্যবাহী ও জরুরি যানবাহন চলাচলের কথা থাকলেও অনেকে ব্যক্তিগত গাড়িও চলাচল করতে দেখা যায়।
এদিকে লকডাউনে মহাসড়কে চলছে রিকশাাসহ কম গতির যানবাহন। এইসব যানবহনে স্বাস্থ্যবিধির কোন তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। এছাড়াও এইসব কমগতির গাড়ি মহাসড়কে এসে গাড়ি চালানোর কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনাও।
হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি এখন একটি জটিল পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। এখন গ্রামেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। লকডাউন অমান্য করে ছোট ছোট যানবাহনগুলো সড়কে চলাচল এবং যাত্রী পারপারের করতে থাকলে তাহলে লকডাউন বাড়িয়েও কোন ফলাফল আসবে না। তিনি আরও বলেন, করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে সড়কে ছোট ছোট মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার কিংবা ভ্যান গাড়িতে যাত্রী ঠাসাঠাসি করে চলাচল বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আরো কঠোর হতে আহ্বান জানান তিনি।
অন্যদিকে, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের কয়েকটি পয়েন্টে ও শিমুলিয়া ঘাটের প্রবেশ মুখে রয়েছে পুলিশের চেকপোস্ট। চেকপোস্টে যাত্রী চলাচল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে পুলিশ। মাওয়া ট্রাফিক পুলিশের ইনচার্জ জাকির হোসেন দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, লকডাউনের নির্দেশনা মানার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু যাত্রীরা বিভিন্নভাবে ঢাকা থেকে ঘাটে আসছে। আবার বাংলাবাজার ঘাট থেকে আসা যাত্রীরা ঢাকা যাওয়ার চেষ্টা করছে। অপরদিকে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়েক কাঁচপুর এলাকায় কথা হয় সিলেটগামী মনির হোসেন সাথে তিনি দৈনিক ইনকিলাকে জানান, গত এক সাপ্তাহে কোঠোর লকডাউনের আজ পঞ্চমদিন পার হচ্ছে এর মধ্যে আজ আবারও আরো ১ সাপ্তাহ সরকারের কঠোর লগডাউনের খবরে মহাসড়কে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। তোফায়েল নামের অন্য যাত্রী জানান, লগডাউনের খবর পেয়ে সজনদের সাথে সময় কাটানোর জন্য বাড়ি যাচ্ছি। রোজার ঈদ বাড়িতে করতে পারিনি। কোরবানির ঈদও যদি করতে না পারি সেই ভেবে এই সসময়টা বাড়িতে কাটাতে চাই। এজন্য বাড়ি ফেরা।
তবে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে কর্তব্যরত নারায়নগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার অমৃত সূত্রধর দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকা থেকে কোনো বাসকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে পিকআপ, ট্রাকসহ পণ্যবাহী যান ছাড়া হচ্ছে। রোগী, জরুরি সেবা, বিদেশগামী ব্যক্তিদের যেতে দেওয়া হচ্ছে। অমৃত সূত্রধর আরও জানান, মাইক্রোবাস, পিকআপ বা মোটরসাইকেলে করে অনেকে যাচ্ছেন। পুলিশ সদস্যরা চেকপোস্টে জিজ্ঞাসা করছেন। জরুরি কারণ দেখাতে না পারলে অর্থদণ্ড দেওয়া হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন