সারাদেশে কঠোর বিধিনিষেধের সপ্তম দিনে দেশজুড়ে কিছুটা শিথিলতা দেখা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাঠে থাকলেও মানুষ ও যানবাহনের চলাচল ছিল মঙ্গলবারের চেয়ে বেশি। তাই দায়িত্ব পালন করতে হিমশিম খাচ্ছে ট্রাফিক পুলিশও। রাজধানীর বাইরে হাটবাজার, অলিগলিতে মানুষের জটলাও ছিল বেশ। এদিকে টানা লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। গতকাল রাজধানীসহ সারাদেশে এমন চিত্র দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, রাজধানীতে অফিসগামীদের ভোগান্তির শিকার হতেও দেখা গেছে। তবে বৃষ্টির কারণে কোনো কোনো চেকপোস্টে ঢিলেঢালাভাবেও বিধিনিষেধ পালন হতে দেখা গেছে। এতে কোনো কোনো সড়কে আবার লম্বা যানজটও তৈরি হয়। দিনভর রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে এক হাজার ১০২জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পাশাপাশি ডিএমপি পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত ২৪৫ জনকে এক লাখ ৭১ হাজার ৯৮০ টাকা জরিমানা করেছে। ৮০৪টি গাড়িকে ১৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
গতকাল রাজধানীর মূল সড়ক থেকে একটু ভেতরের দিকের পাড়া-মহল্লার রাস্তাগুলোতে দোকান খোলা থাকতে দেখা গেছে। প্রথমে অর্ধেক সাটার খোলা রেখে দোকান খুলতে দেখা গেলেও এখন তা মানা হচ্ছে না। বেশিরভাগ দোকানিই পুরো সাটার খোলা রাখছেন। পুলিশের গাড়ি দেখেলে দ্রুত তা নামিয়ে ফেলছেন।
এদিকে, গতকাল শনির আখড়া ও কাজলা সড়কে রিকশা-ভ্যানের চাপে যানজট লক্ষ্য করা গেছে। আর বৃষ্টির কারণে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া মানুষকে। কাজলা থেকে গুলিস্তানগামী সুমন হাওলাদার বলেন, একে তো বৃষ্টি তার উপর যানবাহন নেই। আমাদের মতো মানুষদের অবস্থা নাজেহাল। প্রতিদিন দুর্ভোগে পড়তে হয়। রিকশা পেলেও বাড়তি ভাড়া চাচ্ছে, এতো ভাড়া দিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য কঠিন। যাত্রাবাড়ী সড়কে গাড়ি চলাচল বেশি থাকলেও বিজিবি ও পুলিশের তল্লাশি দেখা গেছে। বাইকগুলো যাত্রী পরিবহন করলে মামলার মুখে পড়ছে। আর রিকশায় চলাচলকারী যাত্রীদেরও পড়তে হচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে। রিকশাচালক সামসুল আলম বলেন, যাত্রাবাড়ী একটু বেশিই কড়া। আগে এমন আছিল না। গত কয়দিন কোনো ঝামেলা ওয় নায়।
গতকাল দুপুর ১২টায় মিরপুর ১০ নম্বরে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট বেলাল বলেন, মানুষের চাপ বাড়ছে। মামলা করার পরেও তারা আবার সড়কে নামছেন। এছাড়া সড়কে প্রচুর গাড়ি বেড়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খোলা। গাড়ি নিয়ে মানুষ কর্মস্থলে যাচ্ছে। এছাড়া চিকিৎসার প্রয়োজনেও প্রচুর মানুষ বের হচ্ছে। মিরপুর ১০ নম্বরে আমাদের দুইটি টিম কাজ করছে। লকডাউন অমান্য করায় দুপুর পর্যন্ত ১০টি মামলা করা হয়েছে। বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে জরিমানাও আদায় করা হয়েছে।
মিরপুর ১০ নম্বরের গোলচত্বরের প্রতিটি মুখে গাড়ির চাপ লক্ষ্য করা গেছে। পুলিশের তল্লালি থাকায় চেকপোস্ট পার হতে গাড়িগুলোকে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। মিরপুর ১৪ নম্বরে গাড়ির তেমন চাপ না থাকলেও ছিল প্রচুর রিকশা। তিন চাকার এই যানটিতে চড়ে যাত্রীদের বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। মিরপুর ১২ নম্বরে পুলিশের কোনো চেকপোস্ট চোখে পড়েনি। সড়কে প্রচুর মানুষকে হাঁটাচলা করতে দেখা গেছে। এ সময় অনেকের মুখেই ছিল না মাস্ক। মালিবাগের সিমেন্টের দোকানদার আউয়াল মিয়া বলেন, গত মঙ্গলবার পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। পরে ২ হাজার টাকা জরিমানা দেই। পরে আবার দোকান খুলছি। দোকান বন্ধ রাখলে ভাড়া, সংসারের খরচ উঠবো কোথা থেকে? এ কারণেই এভাবে কেনাবেচা করতে হচ্ছে।
অপরদিকে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে নিয়মিত বসানো হয় পুলিশের চেকপোস্ট। সেখানে আটজন পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। মাঝে মাঝে দু-একটি ব্যক্তিগত গাড়ি ও রিকশা আটকে যাত্রীদের কাগজপত্র দেখতে চাওয়া হচ্ছে। খুব একটা কারণ জিজ্ঞেস না করে কাগজপত্র ঠিক থাকলে যেতে দেয়া হচ্ছে। সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট আবিদ হাসানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ভোর থেকে এখানে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। যাদের সন্দেহ হচ্ছে তাদের আটক করে কাগজপত্র দেখে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। গাড়ির কাগজ ঠিক না থাকলে মামলা দেয়া হচ্ছে।
ফার্মগেটে দায়িত্বরত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আজাদ রহমান বলেন, প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হচ্ছে। যারাই লকডাউনে কারণ ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেন, প্রশাসনের নজরে এলেই করা হচ্ছে জরিমানা। সকাল থেকে সাতটি মামলা করা হয়েছে। ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে চেকপোস্ট দেখা গেলেও সেখানে দেখা যায়নি দায়িত্বরত কোনো পুলিশকে। এতে নির্বিঘ্নে যানবাহন ও মানুষ যাতায়াত করছে।
গতকাল সকালে মুগদা থেকে গুলশান-১ নম্বরের উদ্দেশে এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে নিয়ে যাচ্ছিলেন মোটরসাইকেল চালক মহসিন হাওলাদার। বাড্ডা চেকপোস্টের সামনে এলে পুলিশ তার গতিরোধ করে। বিধিনিষেধের নিয়ম ভঙ্গ করায় তাকে মামলা দেয়া হয়। পরে চালক মহসিন হাওলাদার বলেন, ঘরে চাল নেই, বাচ্চার দুধ নেই। তাই মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়েছি। পকেটে এক টাকাও নেই। কিন্তু ৫ হাজার টাকার মামলা দিয়েছে পুলিশ।
মোরশেদ-উল-আলম, চিরিরবন্দর (দিনাজপুর) প্রতিনিধিঃ দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে সেনাবাহিনী ব্যাপক মনিটরিং অব্যাহত রেখেছে। গতকাল লে. ইমন ইসলামের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী একটি দল সকাল থেকে উপজেলার বিভিন্ন স্পটে মনিটরিং করেন। ৩টি ইউনিট উপজেলায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা প্রদানের নিমিত্তে ব্যাপক মনিটরিং করে যাচ্ছে। তাদের মনিটরিং সহ উপজেলা প্রশাসনের কঠোর তদারকিতে উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজার গুলোতে জনগণের উপস্থিতি কমে গেছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা সংবাদদাতা: বুধবারও চুয়াডাঙ্গায় কঠোর অবস্থানে ছিল প্রশাসন। সকাল থেকে জেলার প্রবেশ পথগুলোতে চেকপোস্ট বসিয়ে তদারকি করেছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন ১৩ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। অপ্রয়োজনে বাইরে আসা ও স্বাস্থ্যবিধি অমান্যকারীদের জরিমানা করছে ভ্রাম্যমান আদালত। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফিরোজ হোসেন জানান, গত ২৪ ঘন্টায় জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৯টি ভ্রাম্যমান আদালতে ৩৮টি মামলায় ৫২ জনকে ৪৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়াও ২ জনকে এক মাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেছে ভ্রাম্যমান আদালত। লকডাউন বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়মিত টহল অব্যাহত রেখেছে ৪ প্লাটুন সেনাবাহিনী, ৩ প্লাটুন বিজিবিসহ পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। এদিকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে কাঁচাবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান বেলা ১২টা পর্যন্ত খোলা ছিল। সব ধরনের শপিংমল, দোকান ও গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারী রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি ছিল অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশী। শহরের রাস্তা গুলোতে বেশী মাত্রায় যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। পাড়া মহল্লার অলিতেগলিতে দিনরাত বখাটেদের আড্ডা দিতে দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে প্রকাশ্যে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অবৈধ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, থ্রিহুইলার, স্যালোইঞ্জিন চালিত আলমসাধু, নসিমন ও করিমনে গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করছে। এ কারনে চুয়াডাঙ্গা জেলায় আরো বেশী করোন সংক্রমিত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম ব্যুরোঃ সপ্তম দিনে চট্টগ্রামে আরো ঢিলেঢালা ছিলো সর্বত্মক লকডাউন। বৃষ্টির কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তল্লাশি কিছুটা শিথিল হওয়ায় রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যাও বাড়ে। সেই সাথে বেড়েছে লোক সমাগম। হাটবাজার, অলিগলিতে মানুষের জটলাও ছিল বেশ। এদিকে টানা লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। গণপরিবহন বন্ধ। এতে বেকার হাজার হাজার শ্রমিক। মার্কেট, শপিংমল বন্ধ থাকায় কর্মহীন দোকান কর্মচারীরা। ফুটপাতের হকারদেরও দিন কাটছে অভাব অনটনে। কাজের খোঁজে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নগরীতে আসা দিনমজুরাও বেকার। লকডাউনে সবকিছু বন্ধ থাকায় কাজ মিলছে না। এতে বিপাকে পড়েছে দিনে এনে দিনে খাওয়া এসব মানুষ। প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিরাও তাদের পাশে নেই। গেল বছর লকডাউনের দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ান অনেকে। প্রশাসনের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি এবং ধনাঢ্যরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছিলেন। এবার তেমন কিছু নেই। করোনা ঠেকাতে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে হতদরিদ্ররা
মঠবাড়িয়া (পিরোজপুর) উপজেলা সংবাদদাতা : পিরোজপুর সদর নির্বাহী অফিসার বশির আহমেদের নেতৃত্বে মঠবাড়িয়া পৌর শহরে ও বড়মাছুয়া বাজারে বিকেলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। এ সময় স্বাস্থ্য বিধি না মানায় ও লকডাউন উপেক্ষা করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার দায়ে ১৮৬০ এর ২৬৯ ধারায় ৫ জনকে অর্থদন্ড করেন।
মুন্সীগঞ্জ জেলা সংবাদদাতাঃ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিরা মাঠে থাকায় গতকাল কোথাও কোন দোকানপাট খুলেনি। সকল ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। ২১ জন নির্বাহী ম্যাজিষ্টেটের নেতৃত্বে জেলায় ২১টি ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালিত হচ্ছে। লকডাউনের বিধি নিষেধ অমান্য করায় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্বে ১১০ টি মামলায় সর্বমোট ৫৮ হাজার ৯শত টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি ৩ প্লাটুন সেনাবাহিনী ২ প্লাটুন বিজিবি কাজ করছে। প্রতিটি রাস্তার মোড়ে পুলিশ মোতায়েন ছিল।
টাঙ্গাইল জেলা সংবাদদাতা : টাঙ্গাইলে লকডাউন পালিত হচ্ছে। তবে ব্যক্তিগত যানবাহন, রিক্সা ও মানুষের চলাচল বেড়েছে। বুধবার টাঙ্গাইলের বিভিন্ন পয়েন্টে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ৫৪টি চেকপোষ্ট বসিয়ে লকডাউন কার্যকর করতে কাজ করে যাচ্ছে। জেলা প্রশাসনের সহায়তায় মাঠে কাজ করছে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা। র্যাব ও আনসার সদস্যাও মাঠে টহল দিচ্ছে। নির্বাহী ম্যাজিসস্ট্রেটদের নের্তৃত্বে ভ্রাম্যমান আদালত মাঠে কাজ করছে। শহরের রাস্তাগুলোতে মানুষের চলাচল বেড়েছে। তারা পুলিশী চেকপোস্টে জেরার মুখে বিভিন্ন অজুহাত দেখাচ্ছে। অপরদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও কাঁচাবাজার ছাড়াও শহরের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু দোকান-পাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। মহাসড়কে জরুরী পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল করছে। বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন