শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

পরিবার পরিকল্পনায় নারীর পছন্দ ও অধিকার নিশ্চিত করা জরুরী

বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০২১, ৮:২৪ পিএম

আগামী ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। ২০২১ সালের করোনা মহামারী বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে, ‘অধিকার ও পছন্দই মূলকথা ঃ প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার প্রাধান্য পেলে কাঙ্ক্ষিত জন্মহারে সমাধান মেলে।’

গত ১৪ এপ্রিল প্রকাশিত ইউএনএফপিএ’র ‘আমার শরীর, কিন্তু আমার পছন্দ নয়’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে ৫৭ টি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অর্ধেকের বেশি নারী যৌনমিলন, জন্মনিয়ন্ত্রণ এমনকি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারেনা।

এরই ধারাবাহিকতায় করোনা বাস্তবতায় সারা বিশ্বে নারীর প্রতি সহিংসতা, স্বাস্থ্য সেবায় বিঘ্ন, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। ইউএনএফপিএ : ২০৩০ সাল নাগাদ জন্মনিয়ন্ত্রনে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য, মাতৃ মৃত্যুহার কমানো, লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা রোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কিন্তু কোভিড বিশ্বে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাধাগ্রস্ত, বলছে ইউএনএফপিএ।

এদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের ১৮ আর ২২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে। বাল্যবিবাহে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। কিন্তু করোনা মহামারীর মধ্যে এদেশে ১৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে যা বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

ব্র্যাকের গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে, করোনাকালে অভিভাবকের কাজকর্ম না থাকায় ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার কারণে ৮৫ শতাংশ, সন্তানের স্কুল খোলার অনিশ্চয়তায় ৭১ শতাংশ এবং করোনা মহামারী দীর্ঘ স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় অনিরাপত্তা বোধ এবং বাইরে থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়ায় ৬২ শতাংশ বেড়েছে বাল্যবিবাহ। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, লকডাউনে ঘরের মধ্যে পরিচিত মানুষের মাধ্যমে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হওয়াও বাল্যবিবাহের কারণ।

২০২০ সালে অক্টোবরে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উত্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে প্রথম তিন মাসে (মার্চ-জুন ২০২০) সারাদেশে ২৩১টি বাল্যবিয়ে হয়েছে এবং ২৬৬টি বাল্যবিয়ে ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাল্যবিয়ে হয়েছে কুড়িগ্রাম, নাটোর, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলায়। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বলছে, গত জুন মাসে ৪৬২টি কন্যা শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয় এর মধ্যে প্রশাসন ও সচেতন মানুষের আন্তরিক সক্রিয় উদ্যোগে ২০৭টি বিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হয়।

সেভ দ্য চিলড্রেনের গেøাবাল রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যপী আনুমানিক ৫ লাখ মেয়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে, আর বাল্যবিবাহের শিকার ১০ লাখ মেয়ে সন্তানসম্ভবা হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ২ লাখেরও বেশি মেয়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে যার প্রভাব বাংলাদেশের জন্য অশুভ। করোনা মহামারীর কারণে ২০২৫ সালে বাল্যবিয়ের সংখ্যা বেড়ে মোট ৬ কোটি ১০ লাখ পর্যন্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সংস্থাটি।

মেরী স্টোপস বাংলাদেশের আ্যডভোকেসি ও কমিউনেশন হেড মনজুন নাহার বলেন, বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী করোনাকালে প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে অল্প বয়সে গর্ভধারন, গর্ভপাত এবং অনিরাপদ সন্তান প্রসবের বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। উপর্যুপরি, ইতিহাস বলে, এই ধরনের অবস্থার পরপরই গর্ভধারন, বাচ্চা প্রসবের সংখ্যা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারন ও অনিরাপদ গর্ভপাতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং এটি একটি সাধারণ প্রবণতা। তাই সঙ্গত কারনেই মহামারীর প্রথম থেকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সহযোগীতায় মেরী স্টোপস বাংলাদেশের কাজ ছিলো নিরাপদ মাতৃত্ব, সন্তান ধারন, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার এবং এই সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মসূচী এবং তথ্যসেবাসমূহ নিশ্চিত করা।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ শিশু হেল্পলাইন ১০৯৮ এর ব্যবস্থাপক চৌধুরী মোহামেইন বলেন, শিশু বিবাহ রোধে মহামারী কালে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে ৪৫০টি কল পেয়েছে যার সংখ্যা আগের মাসে ছিলো ৩২২টি।এই হার বর্তমান সময়েও ঊর্ধমুখী প্রবণতায় অব্যাহত রয়েছে। আয় কমে যাওয়া বাল্যবিবাহের প্রবনতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে কিনা তার প্রতিক্রিয়ায় ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান নাটালি ম্যাককলে বলেন, দারিদ্র্য অবশ্যই শিশু বিবাহের অন্যতম প্রধান প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। তবে, করোনার কারণে আয় কমে যাওয়ায় দারিদ্র্যের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আমরা এখনো বিশদ তথ্য জানতে পারিনি।

করোনার বিবেচনায় করোনা বাস্তবতায় বদলে যাওয়া পৃথিবীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেকটাই দুর্বল হয়েছে আর পরিবার পরিকল্পনা সেবা খাত আরো অবহেলিত । করোনা দুর্বল করেছে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যখাত এবং দেখিয়েছে জীবন জীবিকার বৈষম্য ও ভারসাম্যহীনতা। জাতিসংঘ বলছে কোভিডের নানামুখী প্রভাবে ২০২০ সালে প্রায় ২ লাখ ২৮ হাজার শিশুমৃত্যু এবং ১১ হাজার মাতৃমৃত্যু হয়েছে।

করোনার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য সেবা, প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা, এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা চরম ব্যহত হয়েছে। ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ,বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একযোগে বলছে সাউথ এশিয়ার ছয়টি জনবহুল দেশ আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলংকা কোভিডের কারণে আশঙ্কাজকনহারে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ায় এবং স্কুল বন্ধ থাকায় ৪ লাখ ২০ হাজার শিশুর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর আশঙ্কায় বেড়েছে বাল্যবিবাহ। যার ফলে ইউএনএফপিএ’র প্রতিবেদন বলছে, অতিরিক্ত ৩ দশমিক ৫ লাখ শিশু গর্ভবতী হয়েছে। ১ দশমিক ৯ লাখ শিশু পুষ্টিকর খাবার বঞ্চিত হয়েছে।

লকডাউন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকায় কর্মসংস্থান, অর্থনীতি, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক শৃঙ্খলার ওপর এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে (বিশেষত যেখানে সামাজিক সুরক্ষা বলয় সীমিত)। তাই লকডাউনের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠার ক্ষমতা ধনী রাষ্ট্রগুলোর থাকলেও নিম্ন ও মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রগুলি এ বাস্তবতায় কতদূর টিকে থাকতে পারবে, সেটি একটি কঠিন প্রশ্ন।

এই অবস্থায় প্রতিদিনই করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে চলেছে।বর্তমান সময়ে সবথেকে কঠিনতম সময় পাড় করছে বাংলাদেশ। বাড়তি সংক্রমণ আর অপ্রতুল চিকিৎসা সেবা নিয়ে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে স্বাস্থ্য খাত।এর মধ্যে জনসংখ্যা দিবস উদযাপনে বাংলাদেশের সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হবে কোভিড মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে সকলের সম্পৃক্ততায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।অনলাইন স্বাস্থ্য সেবার আওতা বাড়াতে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এখনই। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক কাজী মহিউল ইসলামের মতে, করোনাকালে সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে সেবা গ্রহণ অথবা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবার পরিকল্পনা তথ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছে।বর্তমান সময় বিবেচনায় পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান উন্নয়নে আ্যপভিত্তিক সেবার গ্রহনযোগ্যতা বাড়াতে হবে। মোবাইলের ব্যবহার বৃদ্ধি করে ডিজিটাল সেবায় দক্ষ করতে হবে সেবা গ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারী উভয় পক্ষকেই। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের সুখী পরিবার নামক কল সেন্টার ১৬৭৬৭ কল করে সরাসরি ডাক্তারের কাছ থেকে সেবা গ্রহণে গ্রামীণ নারীদের আগ্রহী করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, আ্যপভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে স্বাস্থ্যকর্মীদেরও দক্ষ করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশে ২০২১ সালের প্রথম দিনে জন্ম নিয়েছে ৯ হাজার ২৩৬ শিশু। আর বিশ্বজুড়ে প্রথম দিনে ভূমিষ্ট হয়েছে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৫০৪ শিশু। এই তথ্য দিয়েছে ইউনাইটেড নেশন চিলড্রেনস ফান্ড (ইউনিসেফ)। ইউনিসেফ আরো জানায়, ২০২১ সালে গোটা বিশ্বে ১৪ কোটি নবজাতক জন্ম নিতে পারে। ইউনিসেফ’র তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৮ হাজারের বেশি শিশু জন্ম নেয়। সেই হিসাবে পহেলা জানুয়ারি প্রায় এক হাজার শিশু বেশি জন্মগ্রহণ করেছে।

মহামারীর সময় দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় এর প্রভাবে অর্থনৈতিক সঙ্কট আরো জটিলতার মুখে পড়বে। পরিবার পরিকল্পনায় এখনই যথাযথ উদ্যোগ গৃহীত না হলে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপে বাধাগ্রস্ত হবে সকল উন্নয়ন। আর এ সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করোনাকালীন সঙ্কটে রেপিড সিচুয়েশনাল আ্যসেসমেন্টের মাধ্যমে সঠিক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে তার সমাধানে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের দূর্বলতা পুরো বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে সকল উন্নয়ন একে অন্যের পরিপূরক। জাতি গঠনে আগামীর ভবিষ্যত বিনির্মানে নারীর ক্ষমতায়নের কথা যেমন আমরা বলছি ঠিক তেমনী তার সন্তান গ্রহনের চয়েজ বা পরিবারপরিকল্পনার পদ্ধতী গ্রহনের চয়েজকে বিবেচনায় আনলেই তার অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে বলে আমরা মনে করি। আর এইসকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজন দক্ষ জনগোষ্ঠী। আর তাই বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে এখনই দক্ষতা অর্জনে সকল খাতকে একযোগে কাজ করতে হবে নিজেদের টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন