করোনাভাইরাসের প্রকোপ বিশ্বের সর্বত্র ব্যাপক হারে বেড়েছে। শ্বাসকষ্টের সংক্রমণের মাধ্যমে এ ভাইরাসের আক্রমণ দিনদিন জোরালো হচ্ছে। এ ধরনের রোগ-বালাই একরকম বিপদ। বান্দা যখন বেপরোয়াভাবে গোনাহ করে, আল্লাহতায়ালা তাকে সতর্ক করতে বিভিন্ন পরীক্ষায় ফেলেন; যেনো সে গোনাহ থেকে বিরত থাকে। কোরআন-হাদিসে মহামারি ও বালা-মসিবতকে মানুষের গোনাহের ফসল বলা হয়েছে। সে হিসেবে করোনাভাইরাসও আমাদের গোনাহ ও অন্যায়ের ফসল। এরশাদ হচ্ছে, ‘স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের কারণে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান; যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা রুম : ৪১)। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যখন কোনো কওমে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা তা প্রকাশ্যে করতে শুরু করে, তখন তাদের মাঝে এমন দুর্ভিক্ষ ও মহামারি ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা তাদের পূর্ববর্তীদের মাঝে ছিলো না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪০১৯)।
বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কৃতকর্ম ও তার ফল : মানুষ পাপ করতে করতে যখন পাপের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখনই আল্লাহর শাস্তি নাজিল হয়। পাপিষ্ঠ ফেরাউনকে আল্লাহতায়ালা তখনই পাকড়াও করেছেন, যখন সে নিজেকে আল্লাহ দাবি করেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘মুসা! তুমি ফেরাউনের কাছে যাও; সে অত্যন্ত নাফরমান হয়ে গেছে।’ (সুরা তহা : ২৪)। নমরুদকে আল্লাহ তখনই শাস্তি দিয়েছেন, যখন সে নিজেকে খোদা বলে দাবি করেছে। বনী ইসরাইল তাওরাতকে অস্বীকার, উত্তম খাদ্য (মান্না-সালওয়া)-এর পরিবর্তে নি¤œতর ভোজ্য (ভূমি উৎপন্ন জিনিস) চাওয়া এবং আমালেকা সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আল্লাহর অগণিত নেয়ামত ভোগ করেও অকৃতজ্ঞ হওয়ার কারণে চিরলাঞ্ছনা ও আল্লাহর ক্রোধে পতিত হয়েছে। এভাবে পবিত্র কোরআনে মাদইয়ান সম্প্রদায়, হজরত হুদ (আ.)-এর আদ জাতি, হজরত লুত (আ.)-এর জাতি, হজরত সালেহ (আ.)-এর সামুদ সম্প্রদায়, হজরত নুহ (আ.)-এর জাতি ও হজরত মুসা (আ.)-এর জাতির ধ্বংসের কথা আলোচিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা এদের সবাইকেই তাদের সীমাহীন পাপাচারের কারণে ধ্বংস করেছেন। পূর্ববর্তী নবীদের এসব কাহিনী পবিত্র কোরআনে আলোচনা করে আল্লাহতায়ালা বোঝাতে চেয়েছেন, যদি উম্মতে মুহাম্মদিও তাদের মতো পাপাচারে লিপ্ত হয়, তবে তাদের পরিণতিও অনুরূপ হবে এবং একই ভাগ্য বরণ করতে হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করে দেখো, তোমাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছে! তাদের অধিকাংশই ছিলো মুশরিক।’ (সুরা রুম : ৪২)।
আল্লাহর শাস্তির প্রতিরোধকারী কেউ নেই : আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তিস্বরূপ যখন কোনো আজাব আসে, তখন তা থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহর হাত থেকে কে তোমাদের রক্ষা করতে পারে, যদি তিনি তোমাদের কোনো শাস্তি দিতে চান অথবা তিনি যদি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে চান, তবে কে এ থেকে তোমাদের বঞ্চিত করতে পারে? তারা নিজেদের জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো অভিভাবক বা সাহায্যকারীও খুঁজে পাবে না।’ (সুরা আহজাব : ১৭)। আরও এরশাদ করেন, ‘এসব জনপদের অধিবাসীরা কি এ ব্যাপারে নিরাপদ হয়ে গেছে, রাতে ঘুমন্তবস্থায় এবং দুপুরে খেলাধুলায় মত্ত থাকাবস্থায় তাদের ওপর আমার শাস্তি নেমে আসবে না?’ (সুরা আরাফ : ৯৯-১০০)।
করোনাভাইরাস রোধে করণীয় : সতর্কতামূলক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা : মানুষের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় ইসলাম গুরুত্বারোপ করে। এরশাদ হচ্ছে, ‘ইমানদারগণ! তোমরা সতর্কতা অবলম্বন করো।’ (সুরা নিসা : ৭১)। হাদিসে শারীরিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমার ওপর তোমার শরীরেরও হক রয়েছে।’ (বোখারি : ১৯৬৮)।
আতঙ্কিত নয়, আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হওয়া : আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোনো বিপদই আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ যা তোমাদের জন্য লিপিবদ্ধ করেছেন, তা ছাড়া কোনো কিছুই তোমাদেরকে স্পর্শ করবে না। তিনিই তোমাদের অভিভাবক। আল্লাহর ওপরই মুমিনদের নির্ভরশীল হওয়া উচিৎ।’ (সুরা তওবা : ৫১)। লকডাউন : যে এলাকা করোনায় আক্রান্ত হয়, সেখানে যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়া। এরশাদ হচ্ছে, ‘যদি তোমরা শুনতে পাও, কোনো জনপদে প্লেগ বা অনুরূপ মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, তবে তোমরা সেখানে গমন করবে না। আর যদি তোমরা যে জনপদে অবস্থান করছো, সেখানে এর প্রাদুর্ভাব ঘটে, তবে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না।’ (বোখারি : ৫৩৯৬)।
করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য আইসোলেশন (ওংড়ষধঃরড়হ) : করোনা রোধে আক্রান্ত ব্যক্তিকে পৃথক রাখাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘আইসোলেশন’ বলা হয়। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে পৃথক করে রাখা জরুরি। এতে নিজের ও অপরের ক্ষতি হতে রক্ষা মেলে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অসুস্থকে সুস্থের কাছে নেওয়া হবে না।’ (বোখারি : ৫৭৭১, মুসলিম : ২২২১)। হোম কোয়ারেন্টাইন (ছঁধৎধহঃরহব) : সুস্থ ব্যক্তি করোনায় আক্রান্তের আশঙ্কায় জনবিচ্ছিন্ন থাকাকে ‘কোয়ারেন্টাইন’ বলা হয়। বিভিন্ন হাদিসে এভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন- এরশাদ হচ্ছে, ‘কোনো বান্দা যদি মহামারি আক্রান্ত এলাকায় থাকে এবং নিজ বাড়িতে ধৈর্যসহ সওয়াবের নিয়তে এ বিশ্বাস রেখে অবস্থান করে, আল্লাহ তকদিরে যা চূড়ান্ত রেখেছেন, তার বাইরে কোনো কিছু তাকে আক্রান্ত করবে না, তাহলে তার জন্য রয়েছে শহিদের সমান সওয়াব।’ (বোখারি : ৩৪৭৪, মুসনাদে আহমদ : ২৬১৩৯)।
রোগ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া : কোনো রোগ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা; অবহেলা না করা। এরশাদ হচ্ছে, ‘প্রত্যেক রোগের নিরাময়ক (ওষুধ বা প্রতিষেধক) রয়েছে। বস্তুত যখন কোনো রোগের নিরাময়ক প্রয়োগ করা হয়, তখন সে আল্লাহর অনুমতিক্রমে (ঐ রোগ থেকে) মুক্তি লাভ করে।’ (মুসলিম : ২২০৪, ইবনে হিব্বান : ৬০৬৩)। মোসাফাহা ও কোলাকুলি এড়িয়ে চলা : এসবের মাধ্যমে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। রাসুল (সা.) সাকিফের প্রতিনিধি দলের মধ্যকার কুষ্ঠরোগীকে হাতে হাতে বাইয়াত না দিয়ে লোক মারফত বলে পাঠান, ‘তুমি ফিরে যাও, আমি তোমার বাইয়াত নিয়ে নিয়েছি।’ (মুসলিম : ২২৩১)।
সার্বিক পরিচ্ছন্ন থাকা : কোরআনে কারিমের বহু আয়াতে মুমিনদেরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তওবাকারী ও পবিত্রতা অবলম্বনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা : ২২২)। হাদিসে পবিত্রতাকে ইমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। শরিয়তের বিভিন্ন বিধানকে পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম নির্ধারণ করা হয়েছে। তাছাড়া পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে অনেক উপকার হাসিল হয়। যেমন- অজুর মাধ্যমে মানুষের শরীরের অনাবৃত অঙ্গ-প্রতঙ্গ ধৌত করা হয়, মেসওয়াকের মাধ্যমে মুখের সবধরনের জীবাণু ধ্বংস হয়।
গুজবে কান না দেওয়া ও গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকা : ইসলামে যাচাইহীন কোনো তথ্য গ্রহণ করা নিষিদ্ধ। এরশাদ হচ্ছে, ‘কোনো অসমর্থিত ব্যক্তি কোনো সংবাদ দিলে তোমরা তা যাচাই করো।’ (সুরা হুজুরাত : ৬)। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘যাচাইহীন কথা বিশ্বাস করা মিথ্যুক হবার জন্য যথেষ্ট।’ (মুসলিম : ৫)।
ঘরে নামাজ আদায় করা : আপদকালীন অবস্থায় রাসুল (সা.) সাহাবিগণকে বাড়িতে নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি মোয়াজ্জিনকে আজানে বলতে বলেন, ‘আলা সাল্লু ফি রিহালিকুম। (তোমরা নিজ নিজ অবস্থানে নামাজ আদায় করো)।’ (বোখারি : ৬৬৬, মুসলিম : ৬৯৭)।
গরিব-অসহায় ও নিম্ন আয়ের লোকদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসা : করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ঘোষিত লকডাউনের দিনগুলোতে গরিব-অসহায় ও নিম্ন আয়ের মানুষের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা বৃত্তবানদের ওপর আবশ্যক। এরশাদ হচ্ছে, ‘খাদ্য দান করো দুর্ভিক্ষের দিনে- এতিম, আত্মীয়-স্বজন অথবা নিঃস্ব মিসকিনকে।’ (সুরা বালাদ : ১৪-১৬)।
করোনার প্রাদুর্ভাব থেকে এড়াতে আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া : আগুন দহন করে বলেই মানুষ আগুন থেকে দূরে থাকে। আবার এ আগুনেই হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে পোড়ানোর জন্য নিক্ষেপ করা হয়েছিলো। কিন্তু সে আগুন তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। কারণ আগুনের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। সব ক্ষমতার উৎস একমাত্র আল্লাহর। তাই তাঁকেই ডাকতে হবে। তাঁর কাছেই পরিত্রাণ চাইতে হবে। নিয়মিত নামাজ আদায়সহ বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার, দোয়া-দরুদ ও কোরআন তেলাওয়াতসহ নফল ইবাদতে মশগুল হতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন