রাজধানীতে বিভিন্ন ভবনের নকশাবহির্ভূত অংশ উচ্ছেদে অভিযান চলছে। বিশেষ করে পার্কিং স্পেসের জায়গায় নির্মিত অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দেয়া হচ্ছে। অভিযানের অংশ হিসেবে গত সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডি, গুলশান এবং উত্তরায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়েছে। অভিযানকালে অবৈধ স্থাপনার জন্য মোবাইল টিম জরিমানাসহ মুচলেকা আদায় করেছে। এ প্রসঙ্গে রাজউকের চেয়ারম্যান একটি দৈনিককে জানিয়েছেন, নগরীর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সড়কে গাড়ি পার্ক করে রাখা হয়। এতে রাস্তায় যানজটের সৃষ্টি হয়। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেসব ভবনে নকশায় পার্কিং আছে কিন্তু বাস্তবে সেখানে বাণিজ্যিক স্থাপনা বানানো হয়েছে, সেসব স্থাপনা ভেঙে দেব। যে কোনো মূল্যে ভবনের পার্কিং স্পেস উদ্ধার করব। এ অবস্থা থেকে পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই। পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৮ জানুয়ারি থেকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এ অভিযান শুরু করেছে। চলবে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে।
একটি বাসযোগ্য পরিচ্ছন্ন রাজধানী গড়ে তুলতে অবৈধ উচ্ছেদের কোনো বিকল্প নেই। কেন এবং কী কারণে রাজধানীজুড়ে অবৈধ স্থাপনা তৈরি হয়েছে বা হতে পেরেছে, সে আলোচনায় নতুনত্ব কিছু না থাকলেও এ কথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই যে, রাজনৈতিক প্রভাব ও রাজউকের একশ্রেণীর কর্মকর্তার অবৈধ অর্থের লালসাই পরিস্থিতিকে গুরুতর করে তুলেছে। ব্যাপারটি এক দিনে হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়মের মাশুলই দিচ্ছে নগরবাসী। বলা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে একটি পরিকল্পিত নগরি গড়ে তুলতে অনীহার কারণেই অবস্থা এরূপ হয়েছে। সে আলোচনা এখন অর্থহীন। এটাই সত্যি যে, অবৈধ স্থাপনাকে একমাত্রিক বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই। অনেক স্থাপনা রয়েছে যা প্রকৃত অর্থেই অবৈধ। আবার অনেক স্থাপনা রয়েছে যা বৈধতার আড়ালে অবৈধ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে খুশি করে টিকে থাকা এসব স্থাপনা নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। আবার দেখা যাচ্ছে, ভবন হয়ত বৈধ, কিন্তু তাতে যেসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে সেগুলো অবৈধ। আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছে স্কুল-কলেজ, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, শপিং মলসহ নানা ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এভাবে যত্রতত্র বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এর ফলে একদিকে যেমনি যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে নানা অবৈধ কারবারও ঠাঁই করে নিচ্ছে বা নিতে পারার মতো বাস্তবতা সৃষ্টি হচ্ছে। নগরীর ফুটপাত থেকে শুরু করে ড্রেন-নর্দমা সবকিছুই এখন অবৈধ স্থাপনার দখলে। সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানীতে পানিবদ্ধতা তৈরি হওয়ার পিছনেও অবৈধ স্থাপনা অনেকাংশে দায়ী। রাজধানীতে এমন অনেক ড্রেন রয়েছে যেগুলোর ওপর অবৈধ স্থাপনা থাকায় বছরের পর বছর পরিষ্কার পর্যন্ত করা হচ্ছে না। এসব অবৈধ স্থাপনা ঘিরে অবৈধ নেশার বাণিজ্যও চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে অনেক দিন থেকে। এহেন বাস্তবতায় সচেতন নগরবাসী অনেক দিন থেকেই একটি পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তুলতে উচ্ছেদ অভিযানের পক্ষে অভিমত দিয়ে আসছে। যানজটমুক্ত করতে সড়কের দু’পাশে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার কথাও অনেক আগে থেকে বলা হচ্ছে। ফুটপাত অন্যদের দখলে থাকলে সাধারণের ফুটপাত ব্যবহারের কোনো সুযোগ থাকে না। এটা সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ হিসেবে বিবেচিত। এবারে যখন উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে, তার আগে থেকেই প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানী-ধানমন্ডিসহ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন এলাকায় দুই হাজার তিনশ’ পঞ্চাশটি ভবনের বেইজমেন্ট ও কার পার্কিংয়ের স্থানে অবৈধভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বলে চিহ্নিত করেছে রাজউক। এ কথাও বলা দরকার, রাজউক এই প্রথমবারই এ ধরনের অভিযান শুরু করেছে, ব্যাপারটি তা নয়। দেখা যায়, একদিকে অভিযান চলে অন্যদিকে আবার পরিস্থিতি যা তা-ই দাঁড়ায়। এ নিয়ে যেন এক ধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে অনেক দিন ধরে। মনে করা হয়, উচ্ছেদ আর অবৈধ স্থাপনা পুনঃস্থাপনের মাঝে চলে টাকার খেলা। রাজউকের এবং আরো কোনো সংস্থার একশ্রেণীর কর্মকর্তাদের পকেট ভারী করার প্রবণতাই প্রবল থাকে বলে ধারণা করা হয়। কেন এবং কী কারণে এমনটা হতে পারছে, সেটিও বের করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে জরুরি হয়ে উঠেছে।
রাজধানীর অবৈধ উচ্ছেদ নিয়ে হেলাফেলা করা বা মুখরক্ষামূলক কর্মসূচির কোনো সুযোগ নেই। এর আগে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কের বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘদিন গেড়ে বসে থাকা বাস-ট্রাক স্ট্যান্ডগুলো উচ্ছেদের ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। নানা মহলের বিরোধিতা সত্ত্বেও কেবল দুর্নীতির সাথে আপস না করা এবং দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণেই এটা করা এবং টিকিয়ে রাখা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রেও কঠোর হতে হবে। কেবল উচ্ছেদ নয়, প্রয়োজনে আইন অমান্যকারীদের প্লট বাতিলসহ কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নগর পরিকল্পনা অনুযায়ী যেখানে যা থাকার কথা সেভাবেই যাতে গড়ে ওঠে তার যথাযথ তদারকি নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ঢাকা যেহেতু দেশের রাজধানী, এটিকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা না গেলে সারা দেশ পরিকল্পনা অনুযায়ী গড়ে তোলা সম্ভব নয়। একটি পরিবেশবান্ধব, যানজটমুক্ত, আবদ্ধ পানিমুক্ত, বাসযোগ্য, দৃষ্টিনন্দন নগরী গড়ে তুলতে সমন্বিত কর্মপন্থার কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে সকলেই আন্তরিক হবেন - এটাই প্রত্যাশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন