অন্তত ৮ পদ্ধতিতে গ্রাহকের অগ্রিম অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে কথিত ‘ই-কর্মাস’ ‘ইভ্যালি’। প্রতারণার অভিনবত্বে ডেসটিনি, ইউনি পে টু, যুবক, আইসিএল, এইমওয়ে এবং ‘ব্রাইট ফিউচার’কেও হার মানিয়েছে। গ্রাহককে লাভের গোলক ধাঁধাঁয় ফেলে প্রতিষ্ঠানটি হাতিয়ে নেয় ৩শ’ ৩৯ কোটি টাকা। এখন এ অর্থের হদিস মিলছে না। ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন- কোথায় গেল এই টাকা? সেটির অনুসন্ধানেই এবার মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এ লক্ষ্যে দুই সদস্যের অনুসন্ধান টিম এখন মাঠে। সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির অপর সদস্য হলেন- উপ-সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ শিহাব সালাম। প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া প্রায় ৩৩৯ কোটি টাকা কোথায় গেছে- সেটি খুুঁজে বের করতে মরিয়া এখন সংস্থাটি। সরকারি ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় অর্থ পাচার হয়েছে কি-না সেটিও খতিয়ে দেখবে। প্রতারণার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কোন কোন ব্যক্তি নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন- অনুসন্ধান করবে সেটিও।
এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান গতকাল শুক্রবার ইনকিলাবকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো একটি চিঠির ভিত্তিতে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। এর আগেও এ বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। ওই অভিযোগ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশসহ সব বিষয়ে দায়িত্ব পালন করবে এ টিম।
এর আগে গত ৪ জুলাই ইভ্যালির বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চারটি সরকারি সংস্থাকে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংস্থা চারটি হলো- দুর্নীতি দমন কমিশন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
দুদককে দেয়া চিঠিতে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ইভ্যালি ডট কম’ নামে একটি ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করে এবং এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠায়।
দুদকের হাতে আসা তথ্যে দেখা যায়, গত ১৪ মার্চ ‘ইভ্যালি ডট কম’র মোট সম্পদ ৯১ কোটি ৬৯ লাখ ৪২ হাজার ৮৪৬ টাকা (চলতি সম্পদ ৬৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩৬ টাকা) এবং মোট দায় ৪০৭ কোটি ১৮ লাখ ৪৮ হাজার ৯৯৪ টাকা।
এ তারিখে ‘ইভ্যালি ডট কম’র গ্রাহকের কাছে দায় ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ ৬ হাজার ৫৬০ টাকা। মার্চেন্টের কাছে দায়- ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫৪ টাকা। গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম হিসেবে গৃহীত ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ ৬ হাজার ৫৬০ টাকা এবং মার্চেন্টের কাছ থেকে ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ ৯৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫৪ টাকার মালামাল গ্রহণের পর স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিষ্ঠানটির নিকট ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ ১ হাজার ৯১৪ টাকার চলতি সম্পদ থাকার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির কাছে চলতি সম্পদ থাকার কথা থাকলেও সম্পদ রয়েছে- মাত্র ৬৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩৬ টাকা।
দুদকের হাতে আসা তথ্যে দেখা যায়, ‘ইভ্যালি ডট কম’র চলতি সম্পদ দিয়ে মাত্র ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ গ্রাহককে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে বা অর্থ ফেরত দিতে পারবে। বাকি গ্রাহক এবং মার্চেন্টের পাওনা পরিশোধ করা উক্ত কোম্পানির পক্ষে সম্ভবপর নয়। তদুপরি গ্রাহক ও মার্চেন্টের কাছ থেকে গৃহীত ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ ১৮ হাজার ১৭৮ টাকার কোনো হদিস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে গ্রাহক ও মার্চেন্ট এর নিকট হতে গৃহিত ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ ১৮ হাজার ১৭৮ টাকা আত্মসাৎ কিংবা অবৈধভাবে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে ‘ইভ্যালি ডট কম’-এর বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক কোনো আর্থিক অনিয়ম পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
ইভ্যালির ৮ পদ্ধতির প্রতারণা :
ইভ্যালির অন্তত ৮ ধরনের প্রতারণার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। গতবছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতারণার বিষয়টি আঁচ করে। এ প্রেক্ষিতে প্রতারণার মাধ্যমে ইভ্যালি কোনো আইন ভঙ্গ করছে কি-না, সেটি খতিয়ে দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশকে দিয়ে একটি তদন্ত পরিচালনা করে।
পুলিশের তদন্তে ইভ্যালির প্রতারণা ও আত্মসাতের বিষয়টি নিশ্চিত হয় সরকার। পুলিশের তদন্তে দেশীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অর্ডার করা পণ্য নির্ধারিত সময়ে ডেলিভারি না দেয়া, গ্রাহকদের সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগ না রাখা, পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হলে অগ্রিম নেয়া টাকা ফেরত না দেয়া, ক্যাশব্যাক হিসাবে টাকা না দিয়ে ই-ব্যালেন্স দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
সূত্রমতে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাঠানো প্রতিবেদনে চাতুর্যের আশ্রয়ে প্রতিষ্ঠানটি অন্তত ২ হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করার তথ্য রয়েছে ইভ্যালির বিরুদ্ধে। অথচ কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন মাত্র এক কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় নানা অভিযোগ জমা পড়ে আগেই। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসার ধরণ দেখে বিশেষজ্ঞরা এই মর্মে আশঙ্কা করে আসছেন যে, এতে করে বিপুল অংকের অর্থ পাচারের সুযোগ রয়েছে।
সূত্রমতে, পণ্য কিনলেই টাকা ফেরতের অস্বাভাবিক অফার দিয়ে ব্যবসা করছে ইভ্যালি। ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক অফার দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ১০০ টাকার পণ্য কিনলে সমপরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি টাকা ফেরত দেয়া হবে। নানা ধরনের লোভনীয় অফার দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করা হচ্ছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইভ্যালির কার্যক্রমের ধরন এমএলএম কোম্পানির মতো। এমএলএম কোম্পানিগুলোর প্রতারণার চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে, ইভ্যালিও তা-ই করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এখানে মানি লন্ডারিং হচ্ছে।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-এর (বিএফআইইউ) এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে এ প্রতিবেদককে জানান, ইভ্যালির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠার পর বিএফআইইউ থেকে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাবের পাশাপাশি চেয়ারম্যান ও এমডি মো. রাসেলের ব্যাংক হিসাব এক মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল। এর মধ্যে বিএফআইইউ থেকে অভিযোগগুলো তদন্ত করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে পাঠানো হয়। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো থেকে আর তাদের ব্যাংক হিসাব স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করা হয়নি। ফলে এক মাস পর তাদের ব্যাংক হিসাব অটো চালু হয়ে যায়। ওই কর্মকর্তা জানান, বিএফআইইউর তদন্তেও ইভ্যালির বিরুদ্ধে উত্থাপিত কিছু অভিযোগের সত্যতা মেলে।
তদন্ত প্রতিবেদনে ইভ্যালিকে প্রচলিত আইন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের নীতিমালা মেনে ব্যবসা করতে নির্দেশনা দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পণ্য অর্ডার করার ক্ষেত্রে অগ্রিম মূল্য পরিশোধের বদলে ইভ্যালিকে ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ পদ্ধতি প্রবর্তনে বাধ্য করতে নির্দেশনা দেয়ার জন্যও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়।
৬ থেকে ৭ মাস আগে অগ্রিম মূল্য পরিশোধের পর এখনও পণ্য কিংবা টাকা ফেরত না পাওয়া ক্রেতাদের সাক্ষাৎকার এবং দেশে প্রচলিত এ সম্পর্কিত আইন পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রতিবেদনে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করে পণ্য বা ফেরত না পাওয়া, গিফট কার্ড পেয়েও তা ব্যবহারের সুযোগ না পাওয়ার যেসব, অভিযোগ ক্রেতারা করেছেন, সেগুলো পুলিশের সিআইডির ‘অর্গানাইজড ক্রাইম’ শাখার মাধ্যমে তদন্ত করে দেখারও পরামর্শ দেয়া হয়। ইভ্যালি এ পর্যন্ত কত অর্ডার নিয়েছে এবং তার বিপরীতে কী পরিমাণ ডেলিভারি দিয়েছে, প্রতি মাসে তার রিপোর্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে জমা পাঠাতে ইভ্যালিকে নির্দেশ দেয়ার সুপারিশ ছিল প্রতিবেদনে।
ইভ্যালির সংঘটিত অপরাধ প্রমাণ হলে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯’ এবং দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর বিভিন্ন ধারায় তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ অনুযায়ী ইভ্যালির এসব অপরাধের দায় কোম্পানি মালিকদের ওপর বর্তায়। মানিলন্ডারিংয়ের অপরাধ প্রমাণিত হলেও প্রযোজ্য ধারায় শাস্তির বিধান রয়েছে। এছাড়া শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া ইভ্যালি ম্যানেজমেন্ট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করতে পারে দুদক। ফলে বিদ্যমান অনেকগুলো আইনেই ইভ্যালির কার্যক্রম অপরাধমূলক বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা। সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ইভ্যালির অপরাধ বহুমুখি। এসব আইনে দুদক, সিআইডি, এনবিআর এবং ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ পৃথক আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১৪ মে যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন নিয়ে একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর ইভ্যালি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে। মাত্র ৫০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধন (পেইডআপ ক্যাপিটাল) নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানটির এখন ‘পেইডআপ পরিশোধিত মূলধন এক কোটি টাকা। ইভ্যালির নিবন্ধিত গ্রাহক এখন ৩৭ লাখেরও বেশি। মাসিক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। ২৫ হাজার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেÑ মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন