স্টাফ রিপোর্টার ঃ মৃতপ্রায় রাজধানীর সঙ্গে নদীপথে যোগাযোগ ও ব্যবসার অন্যতম মাধ্যম বুড়িগঙ্গা-তুরাগ নদী। অপরিকল্পিত ড্রেজিং, দখলদারদের ছোবল ও অবৈধ স্থাপনায় নাব্য সঙ্কটে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে নদীটি। দীর্ঘদিন থেকে এই চালু, এই বন্ধ এভাবেই চলছে ওয়াটার বাস ও বাল্ক হেড/নৌযান চলাচল। সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, নদীতে দু-একটি ছোট নৌযান চলাচল করলেও তা খুবই সীমিত। একই সঙ্গে জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে বিপাকে পড়েছে সিন্নিরটেক, আশুলিয়া, গাবতলী ল্যান্ডিং স্টেশনসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার ব্যবসায়ীরা। এই এলাকার ব্যবসায়ীদের মতে, নদীপথে রাজধানীর সঙ্গে ব্যবসার অন্যতম মাধ্যম এই নদী। অথচ অপরিকল্পিত ড্রেজিং, নদী ভরাট করে দখল ও অবৈধ স্থাপনায় মৃত্যুপায় নদীটি। বর্তমানে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাদের মতে, সম্ভাবনাময় এ খাত থেকে সরকার রাজস্ব পেলেও তা খুবই কম। সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী আগালে এখান থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পেতে পারে।
সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প হিসেবে রয়েছে ঢাকা মহানগরীর চারপাশের নদীগুলো পুনরুদ্ধার, সার্কুলার নৌরুট এবং সড়ক নির্মাণ (ইস্টার্ন বাইপাসসহ)। ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পরিচালক খান মো. নুরুল আমিন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এই প্রকল্প সম্পর্কে নৌপরিবহন সচিব, বিআইডবিøউটিএ ও জেলা প্রশাসকের কাছে জানতে চাওয়া হয়- নদীর সীমানা পিলার স্থাপনের কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে, স্থাপিত পিলার নিয়মিত পরিদর্শন করা হয় কিনা এবং সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে। একই সঙ্গে নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে অবৈধ স্থাপনা অপসারণের মাধ্যমে উদ্ধারকৃত জায়গা কিভাবে দখলে রাখা হচ্ছে এবং বাকি উচ্ছেদের পরিকল্পনা সম্পর্কে। এছাড়াও বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেল উদ্ধার করে পুনঃখননের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে কিনা এবং এ সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে।
জানা যায়, বিভিন্ন সরকারের সময়ে বুড়িগঙ্গা-তুরাগ নদীর নাব্য ধরে রাখা, ড্রেজিং কার্যক্রম এবং নদীর দু’পাশের দখলদার উচ্ছেদে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়। কিন্তু সঠিক তদারকি ও পরিকল্পনার অভাবে তা কাজে আসেনি। এদিকে বিএনপি সরকারের সময়ে ২০০২ সালে ঢাকার চারদিকের নদী পথকে গুরুত্ব দিয়ে নৌপথকে সচল করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ওই সময় যাত্রী চলাচলের জন্য করে ওয়াটার বাস প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। কিন্তু তা আর আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীতে বর্তমান সরকারের সময়ে সড়ক পথে চাপ কমাতে যাত্রী চলাচলের জন্য ওয়াটার বাস চালু করা হয়। অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান কয়েক দফায় ওয়াটার বাস চালু করে।
বিআইডবিøউটিএ’র পরিচালনায় ২০১০ সালের ২৮ আগস্ট ‘তুরাগ’ ও ‘বুড়িগঙ্গা’ নামে দুটি ওয়াটার বাস চালু হয়। দ্বিতীয় ধাপে চারটি এবং তৃতীয় ধাপে আরও ৬টি ওয়াটার বাস চালু করা হয়। কিন্তু নদীর নাব্য না থাকা এবং যাত্রী না পাওয়ায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিøউটিএ) প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার টাকা লোকসানে পড়ে। তাই কয়েকবার প্রচেষ্টার পরও বন্ধ করে দিতে হয় এই প্রকল্প। এতে এলাকার ব্যবসা বাণিজ্যে পড়েছে ভাটা। সম্প্রতি বিআইডবিøউটিএ কর্তৃক বাল্কহেড চলাচলে নিষেধাজ্ঞা, উচ্ছেদ অভিযান ও নদীর নাব্য না থাকার কারণে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ইজারা মূল্য মওকুফ করার আবেদন করেছে সূচনা সমবায় সমিতি লিমিটেড।
সরেজমিন গাবতলী থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত পরিদর্শন করে দেখা যায়, নাব্য সঙ্কটে ওয়াটার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। আসছে না বড় কোন বলগেট বা নৌযান। বলতে গেলে ছোট ছোট নৌকা ও নৌযান ছাড়া অন্যান্য নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে ছোট কয়েকটি বাল্কহেড চলাচল করলেও জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। নাব্য সঙ্কটের কারণে বালুবাহী বড় বাল্কহেডগুলো চলাচল একেবারেই বন্ধ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, অতি শীঘ্রই পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং না করানো হলে নৌযান চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। সর্বশেষ গত বছরের ২০ ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির ২৩ তারিখ পর্যন্ত বালুর গদি উচ্ছেদ অভিযানের কারণে ৩৫ দিন বাল্কহেড চলাচল বন্ধ ছিল।
এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাবতলী থেকে আশুলিয়া এলাকার নৌপথে সকল ধরনের ব্যবসা প্রায় বন্ধের পথে। নৌপথে এই এলাকার অন্যতম ব্যবসা ‘বালু ব্যবসা’। নাব্য সঙ্কটে নৌযান ঢুকতে না পারায় এই ব্যবসাও এখন বন্ধের পথে। ব্যবসায়ীদের মতে, নাব্য সঙ্কটে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এলাকার বাসিন্দা মো. নাদিম (৪০) জানান, দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় আছি। ৭/৮ বছর পূর্বে এই নদীর অবস্থা কিছুটা ভালো ছিলো। দিন যত গড়াচ্ছে আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদী। তিনি জানান, নাব্য না থাকায় ৬ ফুটের উপরের বড় বলগেট ঢুকতে পারে না। এছাড়াও অন্যান্য বড় নৌযানও আসছে না। তাই কিছুটা হলেও বিপাকে এই এলাকার ব্যবসায়ীরা।
সিন্নিরটেক ল্যান্ডিং স্টেশনের ইজারাদার মজিবুর রহমান সারোয়ার জানান, নাব্য সঙ্কটে নৌযান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট ছোট কিছু নৌযান আসলেও পানি না থাকায় বড়গুলো আসতে পারছে না। এ কারণে আমাদের পাশপাশি এখানকার ব্যবসায়ীরাও বিপাকে। আর্থিকভাবে প্রতিনিয়ত ক্ষতির মুখে পড়ছি আমরা। তিনি বলেন, ৬৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় সিন্নিরটেক থেকে আশুলিয়ার নৌযানের মালামাল উঠানামার জন্য সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছি। নৌযান না আসায় এবং বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় ঘাটের দৈনন্দিন খরচ মিটানোই দূরহ হয়ে উঠেছে।
গাবতলী ল্যান্ডিং স্টেশন শুল্ক আদায় ও লেবার হ্যান্ডলিংয়ের (কেন্টিনসহ) ইজারাদার মো. লুৎফর রহমান জানান, ১ কোটি ৫ লাখ টাকা দিয়ে তারা স্টেশনের ইজারা নিয়েছেন। অথচ নাব্য সঙ্কটে নৌযান আসতে না পারায় তারা এখন বিপাকে। ব্যবসাতো দূরের কথা ইজারার অর্ধেক টাকাই উঠানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা বলেন, বিভিন্ন সময়ে নদী ড্রেজিং ও নাব্য সঙ্কটে পদক্ষেপ নিলেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কোন কিছুই সম্ভব হয়ে উঠেনি। তাদের দাবি সরকার নাব্য সঙ্কট দূর করতে পারলে সড়কপথের পাশপাশি নৌপথে রাজধানীর সঙ্গে ব্যবসাসহ মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হতো।
নাব্য ও দখলদারদের উচ্ছেদ এবং সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিøউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর এস মোজাম্মেল হক ইনকিলাবকে বলেন, রাজধানীর চারপাশের নদীর নাব্য ও উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রতি সপ্তাহেই আমি পরিদর্শনে যাচ্ছি। যেখানে যেখানে চর দেখা দিয়েছে তার প্রত্যেকটা স্থান চিহ্নিত করে খনন করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। একই সঙ্গে ইতোমধ্যে দুটি প্রাইভেট কোম্পানিকে খননের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এছাড়া পুরো নদীতে ড্রেজিং দরকার বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিগগিরই ড্রেজিংয়ের জন্য দুটো ড্রেজার আনা হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন