সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলা সংবাদদাতা : সিরাজগঞ্জের পশ্চিমপাড় ও টাঙ্গাইলের পূর্বপাড়ে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে অবাধে বালু উত্তোলন করায় চরম হুমকির মুখে পড়েছে বঙ্গবন্ধু সেতু। পশ্চিমপাড়ে সিরাজগঞ্জ অংশের যমুনা সেতুর নিরাপত্তা বেষ্টনি এলাকা জুড়ে বালুর পাহাড় গড়ে তুলা হয়েছে প্রায় ১০/১২টি স্পটে। এ নিয়ে সংঘর্ষ ও নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও টনক নড়ছে না প্রশাসনের। বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড়ে যমুনার উত্তর ও দক্ষিণ পাশে ভূঞাপুর ও কালিহাতী অংশে স্থানীয় বালু ব্যবসায়ীরা পৃথক পৃথক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। দেদারসে চালাচ্ছে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে ১২টি ঘাটের মাধ্যমে অবাধে বালু উত্তোলন। এর ফলে দেশের বৃহত্তর স্থাপনা বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড় চরম হুমকিতে পড়েছে। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞমহল উচ্চ পর্যায়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
এদিকে এ বালুমহালের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে সিন্ডিকেটে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বার বার নিষেধ করা সত্তে¡ও বঙ্গবন্ধু সেতুর উভয় পাড়ে উত্তরে ভূঞাপুর ও দক্ষিণে কালিহাতী উপজেলার অংশে পৃথক দুইটি সিন্ডিকেট অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও পরিবহন করছে।
এর মধ্যে উত্তর অংশে ভূঞাপুর উপজেলার সিরাজকান্দি, নিকরাইল ও গোবিন্দাসী এলাকায় ৮টি পৃথক পৃথক স্থানে স্থানীয় প্রভাবশালী আ. হাই, মো. ফিরোজ, আ. সামাদ, মাসুদ মেম্বার, হাবিব মাস্টার, ফেরদৌস প্রামাণিক, মো. দুলাল চকদার ও আ. মতিন সরকার সেতু বিভাগের পুকুরের পাড় দিয়ে বালু পরিবহনের রাস্তা তৈরি করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও দেশব্যাপী সরবরাহ করছেন। অপরদিকে, পূর্বপাড়ের দক্ষিণাংশে সেতুর প্রায় ৩০০ গজ দক্ষিণে কালিহাতী উপজেলার বেলটিয়া, শামশৈল, চরসিঙ্গুলী ও আলীপুর মৌজায় ড্রেজার বসিয়ে আড়াই মাস ধরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। কালিহাতী উপজেলার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হযরত আলী তালুকদার, প্রভাবশালী হান্নান হাজী, ছোট আ. হাই আকন্দ ও লিয়াকত আলী তালুকদারের নেতৃত্বে একাধিক স্পটে পৃথক ৪টি ঘাট স্থাপন করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও সরবরাহ করা হচ্ছে। উত্তোলন করা বালুভর্তি ট্রাকগুলো সেতু সংলগ্ন গ্যাসফিল্ডের ওপর দিয়ে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করছে। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এদিকে, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন-৩ শাখার স্মারক (নং-৪২.০০.০০০০.০৩৬.১৪.০১১.১৪-৭০৬, তাং-০৩/১১/২০১৫ইং) এর পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগ উপরোল্লেখিত এলাকায় বালু উত্তোলন ও সরবরাহ বন্ধে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসকের কাছে পত্র দিয়েছে। সেতু বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মাহমুদ ইবনে কাসেম স্বাক্ষরিত পত্রে (স্মারক নং-৫০.০০.০০০০.২০১.৩১.০০১.১৫-২৬, তাং-১৩/০১/২০১৬ইং) বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ বালু উত্তোলন বা স্তূপের জন্য কোনো জমি কখনো ইজারা দেয়নি বা দেয়া হয় না।
সরেজমিন ঘুরে ও স্থানীয়দের অভিযোগে জানা যায়, বালুমহালের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যমুনায় জোড়া খুন, এলাকাভিত্তিক নানা দ্ব›দ্ব, হামলা, মামলা ও সংঘর্ষের কারণে যমুনা নদীর ভূঞাপুর ও কালিহাতী অংশে দীর্ঘদিন বালু উত্তোলন বন্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ নামধারী স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও জলদস্যুদের সহযোগিতায় যমুনা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে দেদারছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
অবৈধ বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে নদীতে ক্রমেই বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। বালুমহাল থেকে উপার্জিত অর্থের একটি অংশ চলে যাচ্ছে প্রশাসন ও জলদস্যুদের হাতে। নয়া উদ্যমে বালু উত্তোলন শুরু করায় এলাকাভিত্তিক পুরনো দ্ব›দ্ব আবার প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। যে কোনো সময় বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় ড্রেজার মালিকদের দাবি, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের এ সাইটের প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদের মৌখিক অনুমতি নিয়েই এই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তারা আরও জানান, বিবিএ ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেতু ও সেতু রক্ষাকারী বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকা থেকে বালু উত্তোলন ও বালু সরবরাহ করার রাস্তা তৈরি করার মৌখিক অনুমতি দেন। স্থানীয় কয়েকজন বালু ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রশাসন, আওয়ামী লীগ নেতা ও দুই একজন এমপিকে নজরানা দিয়ে তাদের এই ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। ওইসব বালু ঘাট থেকে প্রতিদিন ৭-৮শ’ ট্রাক বালু সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব মহাল থেকে উত্তোলন করা বালু বিক্রি হচ্ছে রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জসহ আশপাশের কয়েকটি জেলায়। তারা আরও জানায়, প্রতি মাসে বালু মহাল থেকে তাদের আয় হয় কোটি টাকা। এখান থেকে সরকারকে রাজস্ব দিতে হয় না কানাকড়িও। এ বালু মহালের অধিকাংশ লভাংশই হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, যমুনা নদী শাসনের লক্ষ্যে ক্যাপিটাল ড্রেজিং অব রিভার সিস্টেম ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দুই দফা নদী খনন ও ক্রসবাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে। প্রথম দফায় ২০১০ সালে ৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে গোপালপুর উপজেলার নলিন পয়েন্টে ৩ কিলোমিটার ক্রসবাঁধ নির্মাণ এবং নদীর পশ্চিম অংশে ২ কিলোমিটার নদী খননের কাজ করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন