শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

বাড়াবাড়ি বন্ধ করতে হবে

প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন, তখন পুলিশ এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় এমপিকে নিয়ে ফেইসবুকে আপত্তিকর কমেন্টস করায় টাঙ্গাইলে কিশোর শিক্ষার্থী সাব্বিরের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টের কারাদ-ের শাস্তি ঘোষণায় পুরো দেশেই এক ধরনের বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। গত মঙ্গলবার সেই শিক্ষার্থী সাব্বির আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে স্থানীয় এমপি, টিএনও এবং ওসি কিভাবে তার উপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে তার বর্ণনা দিয়েছে। এমপি’র বিরুদ্ধে ফেইসবুক স্ট্যাটাস লেখাকে কেন্দ্র করে স্কুল ছাত্র সাব্বিরের উপর একাধিকবার নির্যাতন এবং মোবাইল কোর্টের শাস্তির ধারাবাহিক প্রক্রিয়া শুধু পুলিশ নয়, স্থানীয় এমপি, থানা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ওসি’র সরাসরি সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে এই ঘটনাটি দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত হিসেবে নতুন মাত্রা লাভ করেছে। ফেইসবুকে কথিত কমেন্টস করার অপরাধে দ-প্রাপ্ত নবম শ্রেণীর ছাত্র সাব্বিরকে থানায় নিয়ে কিভাবে চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে উচ্চাদালতে দেয়া তার বর্ণনায় আদালত স্তম্ভিত হয়েছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়। ফেইসবুকে কথিত মন্তব্যের অভিযোগ তুলে একজন মাইনর বা কিশোরের উপর ইউএনও, থানার নির্বাহী এবং এমপি’র এহেন অমানবিক ব্যবহারে সমগ্র জাতি স্তম্ভিত ও লজ্জিত।
গতকাল একটি সহযোগী দৈনিক পত্রিকায় নিরীহ নিরপরাধ মানুষের উপর পুলিশী নির্যাতনের আরেকটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর রোডের একটি মাঠের পাশে ৩ বন্ধু রাসেল আহমেদ (১৮), রুবেল হোসেন (২২) এবং রুহুল আমীন (২১) আড্ডা দেয়ার সময় তিন পুলিশ সদস্য তাদের সন্দেহজনক হিসেবে আটক করার সময় তাদের তল্লাশি করে আপত্তিকর কিছু না পেলেও একজন কনস্টেবল একটি সিগারেটের প্যাকেটে মাদক থাকার অভিযোগ তুলে তাদের থানায় নিয়ে যায়। সুনির্র্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই মিথ্যা অভিযোগে ২৩ ঘন্টা থানায় আটক রাখার পর মুক্তিপণ দাবীসহ নানা নাটকীয়তার পর তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ। ইতিপূর্বে গত জুলাই মাসে যশোরে স্কুল ছাত্র রোহিতের উপর পুলিশী নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তে সত্য বলে প্রমাণিত হয়। মোটর সাইকেল চুরির মিথ্যা অভিযোগে রোহিতকে ধরে নিয়ে থানায় নির্যাতন চালানোর এক পর্যায়ে পুলিশকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে রোহিতকে ছাড়িয়ে আনে রোহিতের পরিবার। বাদশাহ ফয়সাল স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র রোহিত পুলিশের নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল বলে তার পরিবার জানিয়েছিল। গতকাল আরেকটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে সাতক্ষীরায় পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্যের এক বিস্ময়কর চিত্র পাওয়া যায়। সেখানকার ‘থানাগুলোকে মানুষ বেচাকেনার হাট’ বলে শিরোনাম প্রকাশ করেছে পত্রিকাটি। এমনকি স্থানীয় আওয়ামী লীগও স্থানীয় পুলিশ সুপারের প্রতি হয়রানি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে বলে সংবাদটিতে বলা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে নিরীহ মানুষের উপর পুলিশের নির্যাতন ও গ্রেফতার বাণিজ্যের এমন আরো বহু ঘটনার তথ্য তুলে ধরা যায়।
দেশে এখন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নেই। গণতন্ত্র চর্চার স্পেস অত্যন্ত সীমিত। কিশোর-তরুণদের সংস্কৃতি চর্চা ও খেলাধুলার সুযোগও সঙ্কুচিত। অন্যদিকে গণতন্ত্রহীনতা এবং রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, তীব্র বিভেদ ও দোষারোপের রাজনীতির কারণে দেশে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস মাথাচাড়া দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। এহেন বাস্তবতায় সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে যখন জিরো টলারেন্স দেখাতে বলা হয়েছে, তখন পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন তাদের আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। যেখানে সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয় ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অসহায় মানুষ পুলিশের সক্ষমতা ও পেশাদারী ভূমিকা প্রত্যাশা করে, তখন পুলিশ বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যই পেশাদার অপরাধীর মত মুক্তিপণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। ফেইসবুকে কমেন্টস লেখার কারণে এবং বৈকালিক আড্ডা থেকে তরুণদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় দেশের যুব সমাজ এখন ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। জঙ্গিবাদের নাম করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্দানশীল মেয়েরাও নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এমনিতেই যেখানে দেশের যুব সমাজের একটি বড় অংশ নানা কারণে রাজনীতি বিমুখ ও হতাশ হয়ে যেনতেন প্রকারে দেশ ছাড়ছে অথবা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে সেখানে বিনা অপরাধে পৃুলিশী ধরপাকড় ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা তাদের হতাশাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। মানবাধিকার ও আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে অপরাধী পুলিশ এবং জনপ্রতিনিধিরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পুরো সমাজকে এক ধরনের আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রেখে দেশ সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না। আগামী দশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ গড়তে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের স্বার্থে দেশে আইনের শাসন ও সামাজিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরী।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আরো বাড়াতে হবে
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির এসটিমেটেড হারে পরিবর্তন এনেছে। ব্যাংকের হিসাবে এটা ৭.১ শতাংশ, যা সরকারের এসটিমেটেড হারের থেকেও বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে তা ৭.০৫ শতাংশ। উল্লেখ্য, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্ববর্তী পূর্বাভাস ছিল ৬.৭ শতাংশ। চলতি বছরে এডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধারণার চেয়েও ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর পেছনে প্রধান ভূমিকায় থাকতে পারে রফতানি ও রফতানি আয় বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ ভোগ বৃদ্ধি। নানা রকম প্রতিবন্ধকতা ও বাধা সত্ত্বেও রফতানি আয় বাড়ছে। এই সঙ্গে সরকারী কর্মচারীদের নতুন বেতন স্কেল কার্যকর করায় ক্রয়ক্ষমতা ও ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের এসটিমেটেড হারের চেয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পাওয়া নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। এ ধারা ধরে রাখা শুধু আবশ্যক নয়, জরুরিও বটে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধির ওপর দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির বিষয়টি বিশেষভাবে নির্ভর করে। এটা ঠিক, যদি বিনিয়োগ আকাক্সক্ষা অনুযায়ী বাড়ত, শিল্পায়ন, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়ত তাহলে রফতানি যেমন আরো বাড়ত তেমনি ভোগ ও ক্রয়ক্ষমতাও বাড়ত। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও বৃদ্ধি পেত। অর্থনীতিবিদদের মতে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দুই সংখ্যায় নিয়ে যাওয়া মোটেই কঠিন বা অসাধ্য নয়। এ জন্য বিনিয়োগ-শিল্পায়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সরকার অবশ্য দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু এসব চেষ্টা তেমন কোনো কাজে আসছে না। বিনিয়োগে গতি আসছে না। ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র সঞ্চয়ই হোক আর ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণই হোকÑ কোনোটাই বিনিয়োগে আসছে না। কাগজপত্রের হিসাবে বিপুল বিনিয়োগের চিত্র দেখানো হলেও বাস্তবে নতুন বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। দেশের বর্তমান অবস্থা অনেকটাই স্থিতিশীল। তারপরও বিনিয়োগ না আসাটা দুর্ভাগ্যজনক। এটাও লক্ষণীয়, দেশে বিনিয়োগ না হলেও বিনিয়োগযোগ্য বিশাল অংকের অর্থ প্রতি বছর বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশী বিনিয়োগের যখন এই হাল, তখন বিদেশী বিনিয়োগও আসছে না। সেখানেও অনীহা লক্ষ্যযোগ্য।
বিনিয়োগের পূর্বশর্ত বান্ধব পরিবেশ ও লাভের নিশ্চিত সম্ভাবনা। এ ক্ষেত্রে নানা বাধা ও সমস্যা বিদ্যমান। বিনিয়োগ পরিবেশের একটি দিক হলো, বিনিয়োগের সহজ সুযোগ ও অবকাঠাগত সুবিধা। এই সঙ্গে প্রয়োজনীয় উপকরণপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা। অপর দিকটি হলো, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাসহ সার্বিক স্থিতিশীলতা। স্বীকার করতেই হবে, বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা সহজসাধ্য নয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, জমির অভাব, ঋণের উচ্চ সুদহার, অবকাঠামোগত সুবিধার ঘাটতি ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুৎ প্রভৃতির সহজপ্রাপ্যতার অভাবে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে আপাতত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত হলেও যে কোনো সময় উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টিও অত্যন্ত নাজুক। এমতাবস্থায়, বিনিয়োগে গতি বাড়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
বাস্তবতার এই প্রেক্ষাপটেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়া অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। জাতির যে উন্নয়ন আকাক্সক্ষা, সরকারের যে উন্নয়ন পরিকল্পনা, তা বাস্তবায়ন করতে হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দুই সংখ্যায় স্থিতিশীল করার বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, শিল্প-কারখানা স্থাপন করে উৎপাদন, রফতানি ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। উৎপাদন বাড়লে শুধু রফতানিই বাড়বে না, একই সঙ্গে জনগণের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে দেশেও পণ্যের ভোক্তাসংখ্যা বাড়বে। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে তেজীভাব আসবে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও বাড়বে। লক্ষ্য অর্জনে সরকারের প্রধান কাজ হবে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত ও নিশ্চিত করা। এ জন্য বিনিয়োগ সহজ করার পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়নের যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা, গ্যাস-বিদ্যুতের নিশ্চিত সংস্থান করা। একই সঙ্গে সরকারকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার ইতিবাচক উদ্যোগ নিতে হবে, বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কটের আশু সমাধান করতে হবে। নাগরিক নিরাপত্তা, সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলা, আইনের শাসন, সুবিচার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠায়ও কার্যকর উদ্যোগ-পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা আশা করি, সরকার এসব দিকের প্রতি গুরুত্ব সহকারে নজর দেবে। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন