সাংবাদিকতা জীবনে চলারপথে মিজানুর রহমান তোতা ছিলেন আমার অতিপ্রিয় ঘনিষ্ঠজন। তার মতো এতো নম্র, ভদ্র, শান্ত, বিনয়ী মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। হাসি-খুশি ভরা মুখটিতে সবসময় ফুটতো ঝিলিক। ১৭ জুলাই সকালে যশোর থেকে আমার ছোট ভাই শাহিকুল আজমের কাছে থেকে তোতার মৃত্যুর সংবাদটি জানতে পাই। করোনাকালে আমি কিছু দিন যাবত ঢাকায় মেয়ের বাসায় অবস্থান করছি। খবরটি শোনার পর আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। পরে মেয়ের ডাকে আমার সম্বিত ফিরে আসে। তার এই অকাল মৃত্যু আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। বিশ্বাস করতে পারছি না, এত তাড়াতাড়ি তোতা আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবেন, বিদায় নেবেন চিরতরে।
তোতা ছিলেন সত্যিকারভাবেই মনে-প্রাণে একজন জাত সাংবাদিক। তার রক্তে, অস্থি-মজ্জায় ছিল সাংবাদিকতার পরশ। তার পাশাপাশি তিনি একজন কবি, ছড়াকার, লেখক, সাহিত্যিক ও সমাজ উন্নয়ন কর্মী হিসেবেও বহুল পরিচিতি লাভ করে ছিলেন।
সাংবাদিক তোতার প্রতি ছিল আমার বিশেষ দুর্বলতা। তার জন্মস্থান ঝিনাইদহ জেলায়। আমার মাতুলালয় ঝিনাইদহে। সাংবাদিকতা পেশার কর্মস্থলে তার যশোরে আগমন। যশোরে আসার আগে, স্বাধীনতার পূর্বকাল থেকেই তার সাথে আমার পরিচয় ছিল। তার সাথে সুদীর্ঘকালের সম্পর্কের মাঝে কোনো চিড় ধরেনি বা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়নি কখনও। তার সাথে বহুকাল যাবত কাজ করার সুবাদে একে একে মনে পড়ছে অনেক অনেক স্মৃতি, যা কোনো দিন ভোলা যায় না।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর যশোর থেকে মিয়া আবদুস সাত্তারের সম্পাদনায় দৈনিক স্ফুলিঙ্গ আত্মপ্রকাশ করে। মিজানুর রহমান তোতা ১৯৭৯ সালে দৈনিক স্ফুলিঙ্গ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। এর আগে তার ১৯৭৬ সাল থেকেই ছড়া, কবিতা ও সংবাদপত্রে লেখালেখির জগতে প্রবেশ ঘটে। ১৯৭৭ সালে দৈনিক গণকণ্ঠ, সাপ্তাহিক ছুটি, দৈনিক আজাদ প্রভৃতি পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৯৩ সালে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় যশোর সংবাদদাতার দায়িত্ব লাভ করেন।
১৯৮০ সালের কথা, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট রাজধানীর বাইরে সাংবাদিকদের একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। খুলনা বিভাগের সাংবাদিকদের ২৮ দিনব্যাপী এই প্রশিক্ষণে যশোরের সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন জমির আহমেদ টন, আমি, খান হাফিজুর রহমান, ফারাজী আজমল হোসেন, আতিউর রহমান ও মিজানুর রহমান তোতা। খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলার সাংবাদিকদের মধ্যে খুলনা শহরের বিভিন্ন অফিস ও প্রতিষ্ঠানে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আমার ও মিজানুরের স্থান হয় খুলনা সার্কিট হাউসে। প্রশিক্ষণ শেষে প্রেস ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য ৫ দিনব্যাপী নৌ ভ্রমণের ব্যবস্থা করে। আমাদের বহনের জন্য নৌ বাহিনী ও বন বিভাগের ট্যুরিস্ট জাহাজের ব্যবস্থা করে। আমরা উক্ত জাহাজে হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, কটকা ও সুন্দরবনের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করি। যশোরে দৈনিক ইনকিলাব অফিসে গেলে তোতা সেই নৌ ভ্রমণের মধুর দিনগুলোর কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতেন। তার অফিসে গেলে আমাকে কীভাবে খাওয়াবেন, আপ্যায়ন করবেন, এই নিয়ে পিয়নকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলত।
১৯৯৩ সালের মাঝামাঝি। আমি তখন দৈনিক ইনকিলাবের যশোরস্থিত প্রতিনিধি। একদিন রাতে দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন আমাকে টেলিফোনে জানান: আমরা পত্রিকার যশোর অফিস খোলার চিন্তা করছি। আচ্ছা আপনি যে কলেজে আছেন, সেখানে আপনি যে বেতন-ভাতা পান, তা যদি আমরা দেয়ার ব্যবস্থা করি, তাহলে আপনি কি কলেজ ছেড়ে পূর্ণসময় পত্রিকা অফিসের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন? আমি তখন প্রায় ২৮ বছর চাকরি করছি কলেজে। একটি দায়িত্বপূর্ণ পদেও আছি। ফলে আমার পক্ষে এই প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
ইতোমধ্যে মিজানুর রহমান তোতা আমাকে জানান, ভাই, আপনিও চাকরি করেন, ভাবীও সরকারি চাকরিতে। আমার রুটিরুজির বিষয়টি আপনি বিবেচনা করেন। মানবিক দিক দিয়ে এই কথা শোনার পর আমি তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিই। একটি কাগজে পদত্যাগপত্র লিখে তাকে দিই। বাস্তবিকই তার এই আবেদনটি ছিল সম্পূর্ণ মানবিক, রুটিরুজির প্রশ্ন। আমার পদত্যাগের বিষয়টি অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি। তারা এটি মেনে নিতে চাননি। কিন্তু আমি এই বিষয়টি খুব সহজভাবে গ্রহণ করেছিলাম। এই নিয়ে আমার ও তোতার মাঝে কখনও ভুল বোঝা বা সম্পর্কের অবনতি হয়নি। আমার এই ত্যাগ ও উদারতার কথা বিভিন্ন মহলে বহুবার ব্যক্ত করেছেন তোতা। আমার একজন অনুজপ্রতীম সাংবাদিক হিসেবে তার প্রতি স্নেহ-মমতার কোনো ঘাটতি ছিল না। তবে, আমার জীবনে একটি কষ্ট, একটি আফসোস রয়ে গেল, সারাজীবনের মতো শেষবার তার মুখটি আমি দেখতে পেলাম না, শরীক হতে পারলাম না নামাজের জানাজায়।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সন্ধ্যায় যশোরের প্রখ্যাত সাংবাদিক শামছুর রহমান তার পত্রিকা অফিসে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হন। তোতার ইনকিলাব পত্রিকা ও জনকণ্ঠ অফিস ছিল পাশাপাশি। পুলিশ সন্দেহজনকভাবে তাকে গ্রেফতার করে। পরে তাকে ঢাকায় বিশেষ একটি গোয়েন্দা শাখা অফিসে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। তোতা তাদের বারবার বলে আসছিলেন তিনি নির্দোষ। এরপর তাকে আটকে রাখা হয়। পরবর্তীকালে তদন্তের সময় একটি রহস্য উন্মোচিত হয়। তোতার পালবাড়ি বাসভবনের পাশেই তোতা মিয়া নামে একজন ইটভাটা ব্যবসায়ী বসবাস করতেন। সেখানে একটি সাইনবোর্ডে লেখা ছিল ‘তোতা ব্রিকস’। ষড়যন্ত্রকারীরা গোয়েন্দাদের কাছে দরখাস্ত দেয়, এটি সাংবাদিক তোতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সাংবাদিকতার মাধ্যমে কালো টাকা আয় করে তার এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি ইত্যাদি গড়েছেন। বিষয়টি নিয়ে আরও গভীর তদন্ত চলাকালে সব মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। জেল হতে তিনি বেকসুর ছাড়া পান।
তোতা জেলে থাকাকালীন সময়ের পত্রিকা অফিসে ছিল গোয়েন্দা নজরদারি। ফলে ভয়ে অনেকে যেত না তার অফিসে। ওই সময় তার স্ত্রী রেবা রহমানকে পত্রিকা অফিস চালানোর দায়িত্ব দেয়া হয়। আমি সময় পেলেই ছুটে যেতাম ইনকিলাব অফিসে। এতে রেবা খুবই খুশি হতেন, এই ভেবে যে, তাদের এই দুর্দিনে আমি খোঁজখবর নিচ্ছি। তোতা এ নিয়ে আমার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল।
১৯৯২ সালে যশোর প্রেসক্লাব নির্বাচনকালীন সময়ের একটি চমকপ্রদ ঘটনার কথা মনে পড়ে। আমি যশোর প্রেসক্লাবে সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলাম। আমাকে প্রেসক্লাবের সভাপতিপ্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানো হয়। আমার প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী ছিলেন আমার কলেজ জীবনের সহপাঠী সাপ্তাহিক দেশ হৈতিষী পত্রিকার সম্পাদক নুরুল আলম। দুজনের মধ্যে ছিল খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ গভীর সম্পর্ক। আমি তোতাকে বললাম, ‘ফলো মি’ অর্থাৎ আমাকে অনুসরণ করো। তার মোটরসাইকেলে চেপে সোজা গেলাম নুরুল আলমের পোস্ট অফিসে পাড়ার বাসভবনে। আমি তোতাকে সাক্ষী মেনে নুরুল আলমকে জানালাম, বন্ধুর সাথে আমাদের নির্বাচনী লড়াই হতে পারে না। আমাদের বন্ধুত্ব চির অটুট থাকুক। আমি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিলাম বলে উভয়ে বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করলাম তখন। পরে সংবাদপত্রে বিবৃতি পাঠিয়ে প্রত্যাহারের বিষয়টি সকল মহলে অবহিত করি। এরপর মিজানুর রহমান তোতা দেখা হলে প্রায়ই আমাকে বলতেন: ‘ভাই, ফলো মি।’ আজ তোতা নেই। একথা আর বলবে না।
লেখক: প্রবীণ সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন