ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী/ আমার সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতার মতোই রংপুর মেডিকেল কলেজের অবস্থা। নৌকার ধান নয়, হাসপাতাল করোনা রোগীতে ভরে গেছে। দিনরাত ২৪ ঘন্টা দূরদূরান্ত থেকে রোগী আসছে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী হওয়ায় বেড দূরের কথা মেঝেতেও যায়গা নেই। এ এক ভয়াবহ চিত্র। দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ঘন্টায় ঘন্টায় বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, আয়াসহ সংশ্লিষ্টরা।
শুধু করোনা রোগী নয়; সর্দিজ্বরসহ অন্যান্য রোগীর সংখ্যাও রংপুর হাসপাতালে ব্যাপক হারে বেড়ে চলেছে প্রতিদিন। শুধুমাত্র করোনা উপসর্গ নিয়ে গত দুই মাসে ৯ শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালের বর্ধিত করোনা ইউনিটেই এ পর্যন্ত মারা গেছেন ২৮ জন। একের পর এক স্বজন হারিয়ে বুক চাপড়িয়ে আহাজারি করছেন রোগীর স্বজনরা। তাদের আহাজারীতে হাসপাতাল এলাকার আকাশ-বাতাশ ভারী হয়ে উঠেছে। স্বজনদের দাবী এই ৯’শ ২৮ জন রোগীর বেশিরভাগই মারা গেছেন অক্সিজেনের অভাবে। সময়মতো অক্সিজেন দেয়া গেলে অনেক রোগীকে বাঁচানো যেত।
রংপুর বিভাগের ৮ জেলার অঞ্চলে প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বৈশ্বিক মহামারী করোনা। এ অঞ্চলের দেড় কোটির বেশি মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। বিভাগের ৮ জেলায় জন্য আইসিইউ বেড রয়েছে মাত্র ৪৬টি। এর মধ্যে রংপুর ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে ১০টি (সচল ৮টি), রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০টি এবং দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৬টি। প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বর্তমানে রোগীর ঠাঁই মিলছে না এই হাসপাতালে। বরং ধারণ ক্ষমতার চেয়েও বেশি রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে জরুরী ভিত্তিতে রংপুর হাসপাতালের চতুর্থ তলায় একটি ৫০ শয্যার নতুন একটি ইউনিট চালু করা হয়। সেখানে আইসিইউ সুবিধা না থাকায় সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়। করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে বেড খালি না থাকায় বর্তমানে ইউনিটেই করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এরই মধ্যে এখানেও রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় এটিও ভরে যায়। পাশে আরেকটি ইউনিট চালু করা হয়। সেটিও রোগীতে ভরে যায়। প্রতিদিন রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় বর্তমানে হাসপাতালে কোন শয্যা খালি নেই। মহামারী করোনার পাশাপাশি অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের চাপ অনেক বেড়ে গেছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ আকার ধারন করেছে যে, রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন নার্স ও চিকিৎসকগন।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতল সুত্রে জানা গেছে, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ বেড রয়েছে মাত্র ২০টি। রোগীর চাপের কারনে সেকগুলো অনেক আগে থেকেই খালি নেই। হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মুমুর্ষ রোগীদের চাপ প্রতিদিন বাড়তে থাকলেও আইসিইউ বেড খালি না থাকায় আইসিইউতে রোগী নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে মুমুর্ষ রোগীরা সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না। বিভিন্ন জেলা থেকে এখানে প্রতিদিন প্রায় শতাধিক রোগী ভর্তি হয়। মাত্র ২০টি আইসিইউ বেড দিয়ে বিভাগের আট জেলার রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চিকিৎসকগন জানিয়েছেন, শুধুমাত্র রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই কমপক্ষে ১০০ আইসিইউ বেড দরকার। সেখানে মাত্র ২০টি বেড। এই ২০টি বেডে এত বড় হাসপাতালের মুমুর্ষ রোগীদের মেইনটেইন করা সম্ভব নয়।
বর্তমানে রংপুর ও দিনাজপুর ছাড়া বিভাগে বাকি ৬ জেলা কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলার কোনো হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা নেই। গত মাস থেকে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অক্সিজেনের কারনেই অনেক রোগীকে সঠিক চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধুমাত্র উপসর্গ নিয়েই রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিনে ১৫ জনের অধিক মানুষ মারা যাচ্ছেন। রোগীর স্বজনদেরও দাবি বেশিরভাগ রোগীই মারা যাচ্ছেন অক্সিজেনের অভাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি মাসের শুরু থেকেই রংপুর বিভাগের প্রতিটি জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়েই চলছে করোনার রোগীর সংখ্যা। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর হারও। রোগীর সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে অক্সিজেনের সঙ্কট। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অক্সিজেন না পাওয়ায় রোগীর স্বজনরা আহাজারি করে বুক চাপড়িয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন স্থানে। আর এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন হাসপাতালের দালালসহ একটি সিন্ডিকেট। তাদের কাছ থেকে ৩/৪ গুন বেমি দাম দিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনতে হচ্ছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৮০’র দশকে লাগানো অক্সিজেনের পাইপ লাইনগুলো দিয়ে ৩’শ রোগীর শ্বাসযন্ত্র সচল রাখার কথা। কিন্তু বর্তমানে এখানে অক্সিজেন প্রয়োজন প্রায় দেড় হাজার রোগীর। দীর্ঘদিনের পুরনো, জরাজীর্ণ এসব পাইপ লাইনে অক্সিজেন সরবরাহেও রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকি। এসব পাইপ লাইনে অনেকগুলো দিয়েই সঠিক অক্সিজেন পাওয়া যায় না বলেও অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি এসব পাইপ লাইনের যেকোন দুর্ঘটনা কিংবা বিকল হয়ে পড়লে ব্যাপক প্রাণহানির শঙ্কাও করছেন সংশ্লিষ্টগণ।
এদিকে, হাসপাতালটিতে অক্সিজেন সঙ্কটের কথা স্বীকার করলেও করোনা উপস্বর্গ নিয়ে এতগুলো মৃত্যুর ব্যাপারে দায়সারা জবাব দিয়েছেন হাসপতালের পরিচালক ড. রেজাউল করিম। তিনি জানিয়েছেন, করোনা উপসর্গে এতগুলো রোগীর মৃত্যুর হিসেব সঠিক নয়, কম হবে। আর অক্সিজেনের কৃত্রিম সঙ্কট দেখিয়ে বাহির থেকে যারা অক্সিজেন সরবরাহ করছেন তাদের বিরেুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরও জানান, এই সংকট কাটিয়ে নতুন ভাবে আরও একটি অক্সিজেন জেনারেটর স্থাপন করার পরিকল্পনা চলমান রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন