আবু হেনা মুক্তি : খুলনা মহানগরীর বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছে ভৈরব নদীর কোল ঘেঁষে। আর সেখানেই শহর রক্ষা বাঁধ। আর এই বাঁধ এখন হুমকির মুখে। দৈনিক ইনকিলাবে খবর প্রকাশসহ খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির আন্দোলনের ফলে অবশেষে খুলনা শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণসহ ৫টি প্রকল্পের ৩শ’ কোটি টাকা অনুদান দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে জার্মান উন্নয়ন ব্যাংক (কেএফডব্লিউ)। খুলনা সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে “কেসিসিতে জলবায়ু পরিবর্তনে সহনশীল নগর উন্নয়ন কর্মসূচী” নামে একটি প্রকল্প তৈরী করা হয়। এই প্রকল্পেই কেএফডব্লিউ উল্লেখিত আর্থিক সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। এই প্রকল্পের সাথে রয়েছে নতুন রাস্তা নির্মাণ, পুরাতন রাস্তার সংস্কার, ড্রেন ও ফুটপাত আধুনিকায়ন, ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন, জলাধর সংরক্ষণ, খালিশপুরে নিম্নবিত্তদের জন্য আবাসন এবং পাবলিক হল নির্মাণ। অপরদিকে দখল হয়ে যাচ্ছে খুলনা শহর রক্ষা বাঁধ। বাঁধের উপর অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি বাঁধের ওপর অবৈধভাবে দোকান গড়ে ওঠায় এবং যেখানে সেখানে ট্রলার ও নৌকা বেঁধে মালামাল ওঠানামার কারণে বাঁধটির অস্তিত্ব এখন সংকটে পড়েছে। ইতোমধ্যেই বাঁধের একাধিক স্থানে ফাটল ধরেছে। যে কোন মুহূর্তে বড় ধরনের ধস নেমে ব্যাপক য়তির আশংকা করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৩-৯৪ অর্থ বছরে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) আর্থিক সহায়তায় সেকেন্ডারী টাউন ইন্ট্রিগেটেড ফাড প্রটেকশন প্রজেক্টের আওতায় খুলনা শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়। এই প্রকল্পের আওতায় ২৮/২ পোল্ডারে সাড়ে ৩ কিলোমিটার বিকল্প বাঁধ নির্মাণ, ৬টি রেগুলেটর স্থাপন এবং নদীর তীরের ভাঙনকবলিত খুলনা জেলখানা ঘাট, সদর হাসপাতাল, বড় বাজার, আইডব্লিউটিএ ঘাট, রুজভেল্ট জেটি, আনসার ফাওযার মিল ও দৌলতপুর বিএল কলেজ এলাকায় ২ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার জায়গা রক্ষার কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ৩৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা-২ এর তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। নির্ধারিত সময়ের অনেক পর ১৯৯৮ অর্থ বছরে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়।
এই প্রকল্পের আওতায় জেলখানা ঘাট থেকে রুজভেল্ট জেটি পর্যন্ত নদীর তীর সংরক্ষণ কাজকে মোট ১০টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে রুজভেল্ট এলাকায় ২টি, জেলখানা ঘাট থেকে সদর হাসপাতালের পশ্চিম সীমানা পর্যন্ত দু’টি এবং বড়বাজার এলাকার জুতাপট্টি হয়ে আইডব্লিউটিএ ঘাট পর্যন্ত ৬টি প্যাকেজ ভাগ করা হয়। ব্লক তৈরী করে তা’ নদীর কূলে প্লেজ করা হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বাঁধ নির্মাণকালে ব্যবসায়ীদের সাথে শর্ত ছিল যে, নদীর তীর সংরক্ষণ কাজ সম্পন্ন হলে ব্যবসায়ীরা বাঁধের ভিতরের অংশে ব্যবসা করতে পারবেন। তবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের ডিজাইন অনুযায়ী ঘর তৈরী করতে হবে।
কিন্তু বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার পর জেলখানা খেয়াঘাট থেকে ৫নং ঘাট পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা নতুন করে ব্যবসা শুরুর সময় কোন শর্ত মানেননি। ব্যবসায়ীরা বিশেষজ্ঞদের ডিজাইন না নিয়ে ঘর তৈরী করে। অধিকাংশক্ষেত্রে বাঁধ দখল করে কোথাও কোথাও বাঁধের বাইরে গিয়ে নদী দখল করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কোন নিয়মনীতি না মেনে বাঁধ দখল ও নদী দখলের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা ঘর তৈরী করায় শহর রক্ষা বাঁধ হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই হাসপাতাল ঘাট, কালিবাড়ী, ডেল্টাঘাটসহ ৭/৮টি স্থানে শহর রক্ষা বাঁধের ব্লক ধসে নদীগর্ভে চলে গেছে এবং মূল বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় খুলনা শহর রক্ষা বাঁধ রীতিমত হুমকির সম্মুখীন। যা নিয়ে বার বার খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি কর্মসূচী ও সভা-সমাবেশ করে আসছিল। অবশেষে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মেয়র আনিসুর রহমান বিশ্বাসের বিশেষ প্রচেষ্টায় নতুন করে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখছে। আগামী নভেম্বর মাসে খুলনায় আসবে জার্মান প্রতিনিধি দল। সে সময় এই কাজের প্রাক সম্ভাব্যতা জরিপ ও নকশা প্রণয়নের কাজটি চূড়ান্ত হবে। এতে তারা ৩০ মিলিয়ন ইউরো কেসিসিকে অনুদান হিসেবে দিবে।
অপরদিকে, খুলনা বড় বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইনকিলাবকে বলেন, এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা বাঁধ দখল করে ঘর তৈরী করেছে। ব্লক সরিয়ে ছিদ্র করে ঘর তৈরী করা হয়েছে। তাদের কারণেই শহর রক্ষা বাঁধ এখন ক্ষতির সম্মুখীন। খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রকৌশলী জানান, বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক প্রভাবে শহর রক্ষা বাঁধের ক্ষতি হয়েছে। সরকারী চাকরি করে অনেক সময় কথা বলা দুরূহ হয়ে পড়ে। এ কারণে দখলদারদের বিরত করা যায়নি।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সমন্বয় সংগ্রাম কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান ইনকিলাবকে বলেন, খুলনা শহর রক্ষা বাঁধ পুনঃনির্মাণ এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এতে কেসিসি’র শুধু দায়বদ্ধতা থাকলে হবে না জনগণেরও থাকতে হবে। কারণ কেবল প্রকল্প গ্রহণ ও যথেচ্ছারভাবে তা বাস্তবায়ন করে খুলনা শহরকে রক্ষা করা যাবে না। শহর রক্ষা বাঁধ প্রকল্পের গুণগতমান সঠিক হচ্ছে কিনা সে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি শহররক্ষা বাঁধের পাশে যেসব স্থাপনা রয়েছে তার মালিকদেরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সুনাগরিকের দায়িত্ব পালন করতে হবে। তা না হলে সরকারের কোটি কোটি টাকার প্রকল্প ভেস্তে যাবে এবং খুলনা শহর অরক্ষিত হয়ে পড়বে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন