বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভুল নকশায় প্রকল্প বাস্তবায়নের মাসুল

| প্রকাশের সময় : ৩০ জুলাই, ২০২১, ১২:০৮ এএম

সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মেগা প্রকল্প থেকে শুরু করে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শত শত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে ভুল নকশায়। যে সব লক্ষ্য সামনে রেখে এসব প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছিল, ভুল নকশার কারণে তা ভেস্তে গেছে। এহেন বাস্তবতায় শত শত ব্রীজ, কালভার্টসহ শত শত স্থাপনা ভেঙ্গে নতুনভাবে নির্মানের উদ্যোগ নিতে হচ্ছে। ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজধানীর শহীদ বুদ্ধিবীজী সেতু বা বছিলা সেতু নামে পরিচিত তৃতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুসহ ভুল পরিকল্পনা ও ভুল নকশা ও জরাজীর্ণতার কারণে ভেঙ্গে নতুনভাবে নির্মানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিশেষত প্রয়োজনীয় উচ্চতায় নির্মিত না হওয়ায় অনেক সেতুর নিচ দিয়ে কার্গো জাহাজ ও নৌযান চলাচল করতে না পারা এবং নদীর প্রবাহ বিঘ্নিত হওয়ার কারণে সেতুগুলো ভেঙ্গে নতুনভাবে তৈরীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব সেতুর বয়েস ৫ থেকে ২০ বছরের বেশি নয়। অথচ একেকটি সেতু ৫০ থেকে শত বছরের আয়ুষ্কাল হিসেব করে নির্মান করা হয়। যেখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেতু-কার্লভাটের অভাবে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অর্থাভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পের অর্থায়ন সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে ভুল পরিকল্পনা ও ভুল নকশার কারণে জনগণের রাজস্বের টাকায় নির্মিত স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলার বাস্তবতা দু:খজনক।

রাজধানীর যানজট নিরসনের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইওভার হিসেবে মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার নির্মানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল প্রায় ২ দশক আগে। শহরের প্রধান ব্যস্ততম সড়ক হওয়ায় এর নির্মানকাজ যথাশীঘ্র শেষ করার তাগিদ থাকলেও সেতু নির্মানের শেষ পর্যায়ে এসে এর নকশায় বড় ধরণের ত্রুটি ধরা পড়ে। অবশেষে ভুল নকশায় নির্মিত ফ্লাইওভারটি ২০১৫ সালে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ফ্লাইওভারে ওঠা ও নামার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ঢাল ও উচ্চতা বজায় রাখতে না পারায় এই সেতু যানজট নিরসনে তেমন কোনো কাজে আসেনি। একইভাবে মহাখালী ফ্লাইওভারেও নকশাগত ত্রুটির কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। খিলগাও ফ্লাইওভার চালুর কয়েক বছরের মাথায় বড় ধরণের ফাঁটল দেখা গিয়েছিল। যমুনা সেতুতেও বড় ফাঁটল দেখা দেয়ার পর কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে তা মেরামত করা হয়েছিল। এমনকি দেশের বৃহত্তম সেতু প্রকল্প পদ্মাসেতুর তলদেশের মাটি পরীক্ষা, পাইলিং ও পিলারের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ত্রুটি ধরা পড়ায় নির্মানের শুরুতেই বড় জটিলতা দেখা গিয়েছিল। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারগুলোর নির্মান পরিকল্পনা ও নকশায় ত্রুটির কারণে অদূর ভবিষ্যতে এসব স্থাপনাও ভেঙ্গে ফেলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে বলে নগরবিদদের কেউ কেউ মনে করেন। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত একেকটি স্বপ্নের স্থাপনা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের খামখেয়ালিপনা, অদক্ষতা, অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির চিত্র অনেকটাই স্পষ্ট। ত্রুটি ধরা পড়ার পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতার সম্মুখীন করার কোনো দৃষ্টান্ত দেখা যায়নি।

গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের ঝিকরগাছা বাজার এলাকায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের ক্রসবর্ডার রোড নেটওয়ার্ক প্রকল্পের আওতায় ৭২ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ ৬ লেন সেতু প্রকল্পটির ভুল নকশা কপোতাক্ষ নদকে ‘গলাটিপে হত্যার’ আয়োজন বলে অভিহিত করেছে স্থানীয় সচেতন মহল। এ ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নদনদীর প্রবাহ, এর গতি প্রকৃতির শত বছরের ইতিহাস ও সম্ভাব্যতা সামনে রাখতে হয়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ব্রীজটির গার্ডার এখনি নদীর তলদেশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। এ ধরণের ভুল নকশায় সেতু নির্মানের উদ্যোগ টেকসই উন্নয়নের অন্তরায় এবং আত্মঘাতী। এ ধরণের ভুল নকশায় প্রকল্প বাস্তবায়নের ভুরি ভুরি উদাহরণ দেখা যাচ্ছে। পদ্মাসেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, রূপসা রেলসেতু প্রকল্প, খুলনা-মংলা বন্দর রেলপথ নির্মান প্রকল্প, আখাউড়া- লাকসাম রেলপথ নির্মান প্রকল্প, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ উন্নয়ন প্রকল্পসহ বেশকিছু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই, নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মারাত্মক সব ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা যাচ্ছে। এসব ভুলের কারণে প্রকল্পের মূল লক্ষ্য অর্জন যেমন ব্যাহত হয়, বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং পরিবেশগত ঝুঁকি ও স্থায়ীত্বের ক্ষেত্রে বড় ধরণের ঘাটতি দেখা দেয়। শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের পর কোটি কোটি টাকা খরচ করে তা ভেঙ্গে ফেলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এভাবে জনগণের টাকার অপচয় রোধ করা না গেলে উন্নয়নের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন কখনোই সম্ভব হবে না। এটি হঠাৎ করেই শুরু হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে চলা এসব অনিয়ম, অস্বচ্ছতার কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় শত শত স্থাপনা ভুল পরিকল্পনা ও ভুল নকশায় নির্মানের প্রমান পাওয়া যাচ্ছে। এসব স্থাপনা নির্মানের সাথে জড়িতরা দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় ও দায়িত্বহীনতার দায় এড়াতে পারেননা। এদেরকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। ব্রীজ ও সড়ক নির্মানের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রতি অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। গত বুধবার একনেকের ভার্চুয়াল সভায় দেয়া বক্তব্যে ব্রীজ ও সড়ক নির্মানের ক্ষেত্রে যথাযথ উচ্চতা, ওভারপাস, আন্ডারপাস ও ইউলুপ তৈরী করার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সাথে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাই, ভুল নকশা এবং নির্মানের ক্ষেত্রে মান বজায় রাখতে ব্যর্থতার কারণ উৎঘাটনে তদন্ত সাপেক্ষে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন