করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুসংখ্যা বৃদ্ধিতে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য হাসপাতালে শয্যা ও আইসিইউ’র তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই শয্যা খালি নেই। জটিল পরিস্থিতিতে চিকিৎসা দেয়ার জন্য আইসিইউ’র প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে সংকট এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে যে, তা পেতে জটিল রোগীদের দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। কোনো রোগী সুস্থ হলে বা মৃত্যুবরণ করলে আইসিইউ খালি হচ্ছে। এতে অপেক্ষমাণ রোগীদের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে। এমন ঘটনাও ঘটছে, মা আইসিইউতে থাকা অবস্থায় ছেলের আইসিইউ’র প্রয়োজন পাড়ায় মা তা ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি হাসপাতালে সাধারণত খুব বেশি আইসিইউ’র ব্যবস্থা রাখা হয় না। কেবল জরুরি প্রয়োজনে রোগীকে আইসিইউতে নেয়া হয়। সেই হিসাব করেই আইসিইউ’র ব্যবস্থা রাখা হয়। করোনায় অনেক রোগীর আইসিইউ’র প্রয়োজন পড়ে। দেখা যাচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ’র সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলেও রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তা যথেষ্ট হচ্ছে না। গত তিন দিনে রোগীর সংখ্যা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে শয্যা ও আইসিইউ’র সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকট তীব্র হয়েছে রাজধানীর বাইরে থেকে আসা রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে থেকে প্রতিদিন দুইশ’র বেশি রোগী আইসিইউ’র জন্য আসছে। এত রোগীকে আইসিইউ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
আইসিইউ’র জন্য হাহাকার সৃষ্টি হবে কেন, এ প্রশ্ন অনেকের মনে দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে, রোগী ও তার স্বজনদেরও দায় রয়েছে। চিকিৎকরা বলেছেন, একেবারে শেষ মুহূর্তে রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার ফলে আইসিইউ’র প্রয়োজন পড়ছে। যদি সময়মতো করোনা টেস্ট এবং চিকিৎসা শুরু করা হতো, তাহলে রোগী যেমন সুস্থ হয়ে উঠতো, তেমনি হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হতো না। সচেতনতার অভাবের ফলেই হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে মফস্বল এলাকার লোকজনের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা দিলেও যথাসময়ে চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের উদাসীনতা রয়েছে। তারা রোগীর শারীরিক অবস্থা গুরুতর না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসার দ্বারস্থ হয় না। যখন অবস্থার অবনতি হতে থাকে, তখন সংশ্লিষ্ট এলাকার হাসপাতালে যায় এবং সেখানে পর্যাপ্ত আইসিইউ’র ব্যবস্থা না থাকায় ঢাকাভিমুখে ছোটা শুরু করে। রোগী এবং স্বজনদের এই অসচেতনতার কারণে হাসপাতালগুলোতে চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সারাদেশের সংকটাপন্ন রোগীকে যদি ঢাকামুখী হতে হয়, তাহলে কোনোভাবেই হাসপাতালগুলোর পক্ষে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও স্থান সংকুলান করা সম্ভব নয়। আইসিইউ শুধু করোনা রোগীর জন্যই নয়, অন্য রোগীদেরও প্রয়োজন। এ প্রেক্ষিতে, কোনো হাসপাতালের পক্ষেই চাহিদামতো আইসিইউ’র ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক করোনার দ্বিতীয় ঢেউ-এর শুরুতেই বলেছিলেন, জনসাধারণ যদি সচেতন না হয়, তবে সারা বাংলাদেশকে হাসপাতাল বানিয়েও তা সামাল দেয়া সম্ভব নয়। দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে শয্যা ও আইসিইউ’র যে সংকট চলছে, তার জন্য জনসচেতনতার অভাব বিশেষভাবে দায়ী। এ কথাও বলা প্রয়োজন, মফস্বলে যদি সচেতনতা সৃষ্টি এবং চিকিৎসার পর্যাপ্ত সুবিধা নিশ্চিত করা যেতো, তাহলে রাজধানীসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোর হাসপাতালের ওপর রোগীর এত চাপ পড়ত না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু দুর্বলতা এবং লোকবলের সংকট থাকা সত্তে¡ও যথাসাধ্য চিকিৎসা সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। তবে কিভাবে চিকিৎসার পরিধি ও সুবিধা আরও বৃদ্ধি করা যায়, এ ব্যাপারে তৎপরতা চালাতে হবে। জনসাধারণের এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন, যুক্তরাষ্ট্রে যখন সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী ছিল, তখন সেখানেও আইসিইউ’র তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল। সে সময় বৃদ্ধদের পরিবর্তে তরুণদের আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। এমন পরিস্থিতি আমাদের এখানেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে আগে থেকেই সতর্ক হওয়া বাঞ্চনীয়। করোনার লক্ষণ দেখা দিলে শুরুতেই চিকিৎসা নিতে হবে। তাহলে, এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যেমন সহজ হবে, তেমনি হাসপাতালে যেতে হবে না।
করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে হাসপাতাল শয্যা ও আইসিইউ’র যে সংকট চলছে, তা থেকে উত্তরণে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনগণকে সচেতন হতে হবে। নিজের সুরক্ষাবলয় নিজেকেই তৈরি করতে হবে। হাসপাতালে যাতে যেতে না হয় এ জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মাস্ক পরতে হবে। করোনার প্রতিদিনের চিত্র অবলোকন করে এ পরিস্থিতিতে যাতে পড়তে না হয়, এজন্য আগে থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এখন উদাসীন হওয়া মানেই নিজের জীবন বিপন্ন করা। আইসিইউ’র যে সংকটের কথা বলা হচ্ছে, তা মানুষের অসচেতনতা এবং শেষ মুহূর্তে হাসপাতালের দ্বারস্থ হওয়ারই অন্যতম ফল। কাজেই যতই আইসিইউ’র জন্য হাহাকার করা হোক না কেন, সচেতন না হলে এ হাহাকার চলতেই থাকবে। এ থেকে উত্তরণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকলকে আইসিইউ’র সংখ্যা ও অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধিসহ জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে। গণমাধ্যমগুলোকে এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন