চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের জাহাজ ও কন্টেইনার জট অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। মূলত: গত কয়েক মাস ধরেই জাহাজ ও কন্টেইনার জটে বন্দরে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। এরই মধ্যে গত ৫ দিন ধরে প্রাইম মুভার ট্রেইলার মালিক-শ্রমিকদের ঘোষিত কর্মবিরতির কারণে ইয়ার্ডে রেকর্ড পরিমাণ কন্টেইনার স্টকপাইল হওয়ার মধ্য দিয়ে বন্দর পুরোপুরি অচল হয়ে পড়েছে। বন্দরে কন্টেইনার ধারণক্ষমতা যেখানে সর্বোচ্চ ৩৬ হাজার, সেখানে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জমা হওয়া কন্টেইনারের সংখ্যা ছিল ৪০ হাজারের বেশী। মূলত: বন্দর পরিচালনায় অব্যবস্থাপনা, প্রয়োজনীয় ভারী সরঞ্জাম এবং গিয়ারলেস কন্টেনার জাহাজ আনলোড করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক কী গেন্টি ক্রেনের সংস্থান না থাকার জন্যই এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় বলে ইতিপূর্বে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য তথা আমদানি-রফতানি খাতের প্রধান গেইটওয়ে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা, গতিশীলতা ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার উপর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক কিছুই নির্ভরশীল। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ জট, কন্টেইনার জট ও অব্যবস্থাপনা জিইয়ে রেখে জাতীয় অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব নয়। বন্দরের আমদানি-রফতানি ও রাজস্ব প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে এর সক্ষমতা এবং বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাই একটি আধুনিক বন্দর ব্যবস্থাপনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। ক্রমবর্ধমান চাপ সামাল দিতে বন্দরের আধুনিকায়ন, কন্টেইনার টার্মিনাল সম্প্রসারণ ও সময়োপযোগী ব্যবস্থাপনা ও পরিকাঠামোকে সময়োপযোগী করে গড়ে তুলতে বন্দর প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষ কার্যত: ব্যর্থ।
কী গেন্টি ক্রেনের স্বল্পতাসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির অভাবে এমনিতেই চট্টগ্রাম বন্দরে অচলাবস্থা তৈরী হয়েছিল। এরই মধ্যে কন্টেইনারবাহী গাড়ীর মালিক-শ্রমিকদের কর্মবিরতি বন্দর কার্যক্রমে সম্পূর্ণ অচলাবস্থা তৈরী করেছে। সড়ক-মহাসড়ক ও সেতুর উপর অতিরিক্ত ঝুঁকি কমিয়ে রক্ষণাবেক্ষণের স্বার্থে ৪০ ফুট দীর্ঘ ও ৩৩ টনের বেশী ওজনের ট্রেইলারকে ওজন স্কেলে অনুমতি না দেয়ার বিরুদ্ধে প্রাইম মুভার ও ট্রেইলার মালিক-শ্রমিকরা এই কর্মবিরতির ডাক দেয়। আগ্রামী ৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৩৮ টন পর্যন্ত ট্রেইলার জরিমানা ছাড়াই চলাচলের সুযোগের ঘোষণা দিয়ে অচলাবস্থা নিরসনে কর্মবিরতি পালনরত সংশ্লিষ্টদের সাথে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত সমঝোতা বৈঠকটিও ব্যর্থ হয়ে গেছে বলে গতকাল খবর প্রকাশিত হলেও শুক্রবার তারা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেছে বলে জানা যায়। একই সাথে মহাসড়কে চাঁদাবাজি ও হয়রানির প্রতিবাদে আজ শনিবার থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ধর্মঘট শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে গত চারদিনের কর্মবিরতিতে ইতিমধ্যেই দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে যে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে তার দায় কে নেবে? অতীতে প্রভাব অক্ষুণœ রাখতে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কারণে বন্দরের প্রত্যাশিত উন্নয়ন ব্যাহত হয়েছে। সে সব প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে বন্দরে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রাথমিক ধাপসমূহ অতিক্রম করা সম্ভব হলেও তা আশানুরূপ নয়। আগামী ১৫ বছরের মধ্যে বন্দরের কার্গো ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং-এর সক্ষমতা তিনগুণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও জাহাজ জট ও কন্টেইনার জটের চলমান সমস্যা দূরীকরণে তাৎক্ষণিক বা স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এখন নতুন নতুন দাবী দাওয়া তুলে বন্দরসহ পণ্যপরিবহন ব্যবস্থাকেই অচলাবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়ে জাতীয় অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি করা হচ্ছে।
বন্দর পরিচালনায় দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা, অস্বচ্ছতা, অব্যবস্থাপনা ও সিদ্ধান্তহীনতার শিকার হচ্ছে বন্দর ব্যবহার কারিরা। গিয়ারলেস জাহাজ আনলোড করতে অতিরিক্ত সময় ক্ষেপণের ফলে বহির্নোঙ্গরে অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বন্দরের টার্ন এরাউন্ড টাইমের ভিত্তিতে এর মান, সক্ষমতা ও আন্তর্জাতিক রেটিং নির্ধারিত হয়। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জাহাজকে ৩ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত টার্ন এরাউন্ড টাইম ব্যয় করতে হচ্ছে। বন্দরে নোঙ্গর করার পর একেকদিনের জন্য প্রতিটি জাহাজকে গড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার ডলার ডেমারেজ গুণতে হয়। এভাবেই বন্দর ব্যবহারকারিদের অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। বন্দরে আমদানি-রফতানিকারকদের অতিরিক্ত ব্যয়ের এই বোঝা পরোক্ষভাবে দেশের ভোক্তা সাধারণকেই বহন করতে হয়। বন্দরে অচলাবস্থা এবং টেইলার ধর্মঘটে ইতিমধ্যেই দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে তৈরী পোশাক খাতে ৩ হাজার কোটি টাকার শিপমেন্ট বাতিল এবং ৯ হাজার কোটি টাকার পণ্যের হ্যান্ডলিং বন্ধ হয়ে আছে বলে গতকাল প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়। পণ্যবাহী অনেক জাহাজ দিনের পর দিন বহির্নোঙ্গরে আটকে থাকছে, অথবা রফতানি পণ্য লোড না করেও বিদেশী জাহাজ ফিরে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। আমদানি পণ্য হ্যান্ডলিং ও পরিবহন বন্ধ থাকায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পোৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে এবং পণ্যমূল্য বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। প্রাইম মুভার-ট্রেইলার ও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবিসমূহ মেনে নেয়া যেতে পারে। অনাকাক্সিক্ষত চাঁদাবাজি ও হয়রানি বন্ধের পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মহাসড়ক ও সেতুর নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণের স্বার্থে ট্রেইলার-কাভার্ডভ্যানের আকার ও ওজনের সীমা মেনে চলা জরুরী। এখন প্রাইম মুভার-ট্রেইলার ও ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিকদের দাবি-দাওয়া ও ধর্মঘট সমস্যা হয়ে দাঁড়ালেও বন্দরের সমস্যা পুরনো। বন্দর কর্তৃপক্ষের সময়োচিত ও দূরদর্শী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার সুযোগে বন্দরকে ঘিরে গড়ে ওঠা সুবিধাভোগী সিন্ডিকেট বন্দর ব্যবহারকারীদের প্রকারান্তরে জিম্মি করে রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে বন্দরের মাস্টারপ্লান নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সময়ের চাহিদা পূরণ এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এক্ষুণি ত্বরিৎ ও কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। সেই সাথে যাদের কারণে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, ভবিষ্যতে তাদের এ ধরনের কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন