বর্তমানে যারা দিনে-দুপুরে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি করছে এরা কারা জানেন? এরা বিশ্বের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষিত মানুষ। হয়তো অনেকেই বলবে, আমি হঠাৎ শিক্ষিত মানুষের বদনাম কেন করছি? এটা বদনাম নয়, এটা অপ্রিয় সত্য কথা। জাপানের হিরোশিমাতে বোম্বিং করে কারা ধ্বংস করেছিল? শিক্ষিত মানুষ। আমরা বহু বছর ধরে শুধু খুন করছি ইহুদি, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানকে। কখনও কাউকে বলতে শুনিনি যে, আমরা মানুষ হয়ে মানুষ খুন করছি। তাহলে এ পর্যন্ত যারা মারলো তারা কারা ছিলো? মানুষ নামের দানব নিশ্চিত।
যাই হোক না কেন ঘটনা এখন কিছুটা ভিন্ন ধরনের। আসুন, জেনে নিই কিছু তথ্য। এখন ডিজিটাল সিস্টেম গোটা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে, ফলে যদি কেউ ডিজিটাল সিস্টেমকে অ্যাটাক করে তবে অতি সহজ উপায়ে গোটা বিশ্বকে অচল করা সম্ভব। এখন এই ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে দরকার ব্যাকআপ ও সঠিক পরিকল্পনা এবং সেটা হতে হবে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক।
যদি আমি বলি যে, সাইবার অ্যাটাক মাদক বা নার্কোটিকের চেয়ে বড় ক্রাইম এবং বিশ্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট, তবে কেউই অবাক হবেন না। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন এবং অন্যান্য ক্ষমতাধর দেশের আর অস্ত্র তৈরির প্রয়োজন নেই, সাইবার অ্যাটাকই যথেষ্ট।
তারপর আরও বড় সমস্যা হলো, ফোনের নিরাপত্তা নিয়ে। যিনি সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তার মধ্যে আছেন, তিনিও পেগাসাস-এর মতো স্পাইওয়্যারের আক্রমণ থেকে নিরাপদ নন। এই সফটওয়্যার ফোন কল রেকর্ড করতে পারে, এমনকি ফোনের ক্যামেরা ব্যবহার করে গোপনে আপনার ভিডিও ধারণ করতে পারে। আপনি হয়ত হাতের কাছে ফোন রেখে কারও সাথে কথা বলছেন, পেগাসাস আপনার ফোনের মাইক্রোফোনকে জাগিয়ে তুলে আপনার অজান্তেই সেই আলাপ রেকর্ড করে ফেলতে পারে। আপনি কোথায় আছেন, কিংবা কোথায় গিয়েছিলেন, কার সাথে দেখা করেছিলেন, সেসব বিষয়ও পেগাসাস চিহ্নিত করার ক্ষমতা রাখে। আর একবার ফোনে ঢুকে পড়তে পারলে এই স্পাইওয়্যার প্রায় সব ধরনের তথ্য বা ফাইলই নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে।
এখন আসুন সে ভাবনাগুলো কেমন হতে পারে তা নিয়ে কিছু কথা বলি। জীবনে আমরা বহু অ্যাটাকের কথা শুনেছি, যেমন বাঘের অ্যাটাক, শত্রুর অ্যাটাক, করোনার অ্যাটাক ইত্যাদি। এখন প্রযুক্তির যুগে শুরু হয়েছে নতুন আরেক ধরনের অ্যাটাক, তার নাম সাইবার অ্যাটাক। সাইবার অ্যাটাকের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি অবগত। বাংলাদেশে প্রায়ই দেখি অনেকেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, তাদের ফেসবুক হ্যাক হয়েছে। এক দেশ যেমন আরেক দেশকে অ্যাটাক করে, ঠিক তেমনি করে কেউ বা কারা একটি বড় কোম্পানির সিস্টেমে অ্যাটাক করে, যাতে কোম্পানি সঠিকভাবে সবকিছু ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হয়। প্রতিযোগিতার যুগে জিততে হলে যে কোনো মূল্যে প্রতিযোগীকে ঠেকাতে হবে, সেটা হতে পারে সেই প্রতিযোগীর সিস্টেমে অ্যাটাক করে, যা ঘটতে দেখা গেছে গত কয়েক দিন আগে সুইডেনের একটি মুদি চেইন প্রতিষ্ঠানে। এই মুদি চেইনে রয়েছে আটশো দোকান, ফার্মাসি এবং সুইডিশ রেলের টিকিট অফিস। সাইবার অ্যাটাকের কারণে কয়েকদিন ধরে পুরো সিস্টেম অচল হয়ে পড়ে। প্রতিদিন শত শত কোটি টাকা লস, সেইসাথে অনিশ্চিত জীবন অনেকের জন্য। উদাহরণস্বরূপ, কোনও বিদেশি শক্তি হঠাৎ যদি আমাদের অ্যাটাক করে তাহলে সশস্ত্র বাহিনীকে তার মোকাবিলায় এগিয়ে আসা বাধ্যতামূলক। এখন দেশে বিভিন্নভাবে অপরাধীদের অ্যাটাক যেমন, করে মাদক কারবারিদের দ্বারা আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। যেহেতু এটা ঘটছে এবং সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র চুপ থাকতে পারে না। কিন্তু যদি বাংলাদেশ পুলিশ জ্ঞান ও বিধিবিধান থাকা সত্তে¡ও নার্কোটিক নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, সেখানে কীভাবে তারা সাইবার অ্যাটাকের মোকাবেলা করবে? আমরা যখন আরও বেশি সংখ্যক এই ধরনের অ্যাটাকের মুখোমুখি হবো তখন কী ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে বাংলাদেশ এবং কী ধরনের প্রশিক্ষণ তাদের নেয়া দরকার, সেটা এখনই ভাবতে হবে আমাদের। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা বিশ্বের ইন্টারনেট এবং ডিজিটালাইজেশন নিয়ে কতোটা ভাবছি? ভবিষ্যতে আমাদের কী হবে এবং কে আমাদের সুরক্ষা দেবে, তা না ভেবে উপায় নেই।
আমরা ইতোমধ্যে দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন সুইডেনের দোকানে, সীমান্তে, রাজনীতিতে এমনকি সিনেমা হলের টিকিট কাউন্টারে সাইবার অ্যাটাকের কারণে হঠাৎ সিস্টেম কাজ করছে না, সঙ্গে সঙ্গে বিশাল লাইন, অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। সুইডেনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের হার হতাশাজনক। দেশে সাইবার সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি সাইবার লিটারেসিও বাড়ানো হয়েছে। তা সত্তে¡ও সারাদেশ সাইবার অ্যাটাক, নার্কোটিক, মাদক, আগুন লাগানো এবং খুন-খারাবি চলছে সর্বত্র। ইদানিং প্রতিদিনই খবরে জানছি, কেউ না কেউ খুন হচ্ছে। তাই, এখন আর জাস বা ডিনামাইট তৈরি করলেই দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কারণ মানুষ নিজেই এখন বোমা।
করোনাকালে দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সঙ্গে সমান্তরাল হারে বেড়েছে সাইবার ক্রাইম। দেশে ফেসবুক, ইউটিউব, লাইকি, টিকটক, বিগো লাইভের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নানা ধরনের ক্রাইম চলেছে। যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও (পর্নোগ্রাফি) ব্যবহার করে হয়রানি করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনাও বেড়েছে। এ ছাড়া ই-কমার্সে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার ঘটনাও বেড়ে চলেছে।
সবাই শুধু বলছি, শিক্ষণ-প্রশিক্ষণে রদবদল করতে হবে, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। কখনও কি ভাবছি কী অবস্থা প্রতিরক্ষার? দেশে যদি সাইবার অ্যাটক হয়, সেক্ষেত্রে পারবে কি প্রতিরক্ষা বাহিনী তার মোকাবেলা করতে? হঠাৎ যদি দেশের সমস্ত ব্যাংক বা হাসপাতালের সিস্টেমে বহিঃশত্রুর মাধ্যমে সাইবার অ্যাটাক আসে আমরা কি প্রস্তুত হতে পেরেছি তার মোকাবেলা করতে? সবার মুখে একটিই প্রশ্ন, কী করলে ভবিষ্যতে এরকম হ্যাকিং ঠেকানো যাবে। সত্যি কথা বলতে কি, এর কোনো উপায় নেই। ঠেকানো অসম্ভবপর। সমস্যা আসবে তার সমাধানও খুঁজতে হবে। পরাজয় মানে ব্যর্থতা। সুতরাং পরাজয় মানা যাবে না। বিজয়ের জন্য, আত্মরক্ষার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সাইবার অ্যাটাক প্রতিরোধী চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
আলো হলো উজ্জ্বল দীপ্তিময়, অন্ধকার হলো আলোহীন তমসা। আলোর বিপরীত রূপ হলো অন্ধকার। আলোর প্রতি আকর্ষণ যতখানি, অন্ধকারের প্রতি ততখানিই অনাগ্রহ। তবু মেনে নিতে হবে, অন্ধকার আছে বলেই আলো অত দীপ্তিময়, আলোর গৌরব বৃদ্ধি। আলো ও অন্ধকারের মতো মানব সমাজের বিপরীতধর্মী কত কিছুই আছে ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, উত্থান-পতন ইত্যাদি। ঐ বিপরীত ধর্মিতা সৃষ্টিকে করেছে বৈচিত্র্যময়, সুন্দর ও মধুময়।
দুঃখ নেই, শুধু সুখ, সে তো ‘হ্যাপি প্রিন্সে’র মতো বিড়ম্বিত জীবন। পতনের হতাশাময় জীবনের মাঝে উত্থানের আনন্দঘন মুহূর্তের তুলনা হয় না। কাজেই আমাদের কাছে অন্ধকারের মতো মন্দ, পাপ, দুঃখ, বেদনা, নিরাশা, পতন ইত্যাদি যতই অনভিপ্রেত হোক, ওগুলোর প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। এ কথা তো ঠিক যে, ব্যর্থতা ও অসাফল্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সাফল্যের চাবিকাঠি। সে জন্য সৃষ্টিতে বিপরীতধর্মিতার সহাবস্থান অপরিহার্য।
সমস্যা জীবনে আসবে আর তার সমাধান এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সু-শিক্ষা, আত্মবিশ্বাস ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। যখনই সত্যের সাথে মিথ্যার লড়াই হয় তখন সত্য একা হয়ে লড়াই করে। অন্যদিকে অসত্যের দল হয় বিশাল বড়। কারণ, অসত্যের পিছনে মূর্খ, লোভী, স্বার্থপর ও বিশ্বাসঘাতকেরা থাকে। ফলে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন হয়ে পড়ে ঠিকই, তবে সত্যের জন্য লড়াই করতে থাকলে একদিন তারই জয় হয়। আমি বিশ্বাস করি পরিবর্তনে, তাই বিশ্বাস করি উন্নতির ধারায় জাগো, বাংলাদেশ জাগো, নদীময় সোনার বাংলাদেশ গড়তে সবার আগে নতুন করে ভাবো।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন