শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

তিনি ছিলেন নৈতিক সমাজ গঠনের প্রবক্তা

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৯ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

স্রোতের বিপরীতে চলতে পারা দুর্দান্ত মনোবলের এক সাহসী বীরের প্রস্থান।’ বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ও সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিনের ইন্তেকালের খবরটি এভাবেই জানালেন তার পুত্র সালেহীন তানভীর গাজী। শুক্রবার (৬ আগস্ট) রাত ৮টায় ঢাকার শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজেউন।

অসীম সাহসী গাজী সালেহ উদ্দিন প্রায় চার দশক ধরে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামে জড়িত ছিলেন। সাহসের সাথে সত্য কথা বলাই ছিলো তার বৈশিষ্ট্য। সে সত্য যদি তার পক্ষের মানুষের বিরুদ্ধেও হতো তিনি তা বলা থেকে বিরত থাকতেন না। সমাজ নিয়ে তিনি চিন্তা করতেন। নৈতিক সমাজের কথা বলতেন। তার লেখনি, বক্তৃতা-বিবৃতিতে তিনি নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানবিক সমাজ গঠনের তাগিদ দিতেন। তিনি বলতেন, দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা নৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ছি। মানবিক মূল্যবোধ এবং নৈতিক সমাজ ছাড়া এই উন্নয়ন কখনো টেকসই হবে না।

সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ার ঘটনা তাকে পীড়া দিতো। তিনি প্রায়ই বলতেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যে সমাজে নেই, সেখানে নৈতিক সমাজ আশা করা যায় না। গণতন্ত্র বিকশিত হয় না। অথচ, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাই ছিলো গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা। স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরেও দেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে না উঠা নিয়ে তিনি হতাশা ব্যক্ত করতেন তার আলাপচারিতায়। বলতেন, গণতন্ত্রের অপরিহার্য অঙ্গ মানুষের ভোটের অধিকার এবং শক্তিশালী বিরোধী দল।

সমাজে অব্যাহত খুনোখুনি, স্বজনের হাতে স্বজন খুন, পরকিয়া, কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ানক উত্থানের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। কেন এসব হচ্ছে তিনি তা নিয়ে ভাবতেন। তার ভাবনা তিনি প্রকাশ করতেন। এ থেকে পরিত্রাণের উপায়ও বলে দিতেন। তার মতে, ইসলামি শিক্ষার অভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে। তিনি পরিবার থেকেই নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব দিতেন। বলতেন, নিজের বেড়ে উঠার গল্প। মাগরিবের নামাজের আগে ঘরে না ফিরলে মিলতো শাস্তি। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়ায় সমাজে অপরাধের মাত্রা বাড়ছে বলেও মনে করতেন তিনি।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন। তিনি বলতেন শিক্ষিতরাই দুর্নীতি করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে। দুর্নীতি আর অনৈতিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নৈতিক স্কুল’। চট্টগ্রাম নগরীর ঝাউতলায় তার ব্যতিক্রমধর্মী এ স্কুলে পড়ছে সমাজের সুবিধা বঞ্চিত শিশুরা। তিনি তাদের পড়াতেন, নৈতিক শিক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন, নৈতিক স্কুল আমার প্রতিবাদ। এই উদ্যোগে একজনও যদি দুর্নীতি ছেড়ে ভালো পথে আসে সেটাই আমার বড় পাওয়া। অবসর ভাতা এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রাপ্ত ভাতা দিয়ে তিনি এ স্কুল চালাতেন।

খেলাঘর আন্দোলন, বধ্যভূমি রক্ষা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলনে তিনি একজন সামনের কাতারের সংগঠক ছিলেন। যে কোনো পরিস্থিতিতে তিনি সাহসী ভূমিকা নিতেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রেফতারের প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকদের নিয়ে কালো পতাকা প্রদর্শন কর্মসূচি দেন। তার আগের রাতে সাবেক ভিসি মরহুম প্রফেসর ড. আবু ইউসুফের সঙ্গে তাকে পতেঙ্গায় র‌্যাব কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। নানা হুমকির পরও তিনি অটল থাকেন। সরকারি দলের সমর্থক হয়ে তিনি সরকারের অনেক সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতেন।

সর্বশেষ চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগের প্রতিবাদে নাগরিক সমাজের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯ জুলাই সিআরবিতে হাসাপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ কর্মসূচিতে যোগ দেন। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরও তিনি সিআরবির নিয়ে সরব ছিলেন। আইসিইউতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ফেসবুকে তার প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন।

দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডীন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব, বাংলাদেশ সমাজবিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, লেখক। তার বেশ কয়েকটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দৈনিক ইনকিলাবসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন।

গাজী সালেহ উদ্দিনের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরা ইউনিয়নের বদরপুর গ্রাম। শহীদ পরিবারের সন্তান গাজী সালেহ উদ্দিন বড় হয়েছেন নগরীর পাহাড়তলীর পাঞ্জাবী লেনে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আলী করিম এবং মাতা হুরমোজা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান। প্রাণবন্ত হাসি খুশি প্রফেসর গাজী সালেহ উদ্দিন ছিলেন সকলের প্রিয়। দেশ-বিদেশে তার অগণিত ছাত্রের সাথে তার যোগাযোগ ছিলো। তিনি হাসতেন প্রাণ খুলে। সহজে মানুষকে আপন করে নিতেন। আল্লাহ তাকে জান্নাতের মেহমান হিসাবে কবুল করুন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন