ঢাকা বা বাংলাদেশের অন্ধকার জগত সম্পর্কে লেখার জন্য কলম ধরিনি। সত্যি বলতে কী, That is not my cup of tea. তবে পরীমনির গ্রেফতার এবং গ্রেফতার পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গোয়েন্দা বিভাগ বা ডিবির (ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ) যুগ্ম কমিশনার জনাব হারুন সাংবাদিকদের কাছে একটি মন্তব্য করেছেন। ৬ আগস্ট একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত খবর মোতাবেক তিনি বলেন, পরীমনির অন্যতম সহযোগী ও তার কস্টিউম ডিজাইনার জিমিকে সহসাই গ্রেফতার করা হবে। তিনি আরো বলেন, পরীমনি যেসব অবৈধ কাজ ও ব্যবসা করতেন, সেগুলো কাদেরকে নিয়ে করতেন, কাদের সহযোগিতায় করতেন, কারা তার নেপথ্যে রয়েছে, আমরা তাদের নাম পেয়েছি। তার বক্তব্য নোট করছি। যারাই তার সঙ্গে ছিল তাদেরকে গ্রেফতার করা হবে। তিনি বলেন, রাজ একজন লেখাপড়া না জানা মানুষ। সে ছোট একটি চাকরি করতো। বিভিন্ন মডেলকে নিয়ে সে ঘরোয়া পার্টি করতো। উচ্চবিত্তদের মডেল সাপ্লাই দিত। তার কাছ থেকেও আমরা তথ্য পেয়েছি। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
জয়েন্ট কমিশনার জনাব হারুনের এই মন্তব্য পড়ে ভালো লাগলো। গত সপ্তাহে অন্ধকার জগতের নট-নটিদের অনেকের নাম এবং কান্ডকীর্তি একাধিক পত্রপত্রিকায় এসেছে। সেইসব বেপরোয়া উচ্ছৃংখল কার্যকলাপের বয়ান দিতে বসিনি এই লেখায়। কিন্তু এইসব বয়ানের মধ্যেও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য এসেছে। যেমন, অপর একটি বাংলা নিউজ পোর্টাল ৫ আগস্ট লিখেছে, উত্তরার র্যাব সদর দপ্তরে জিজ্ঞাসাবাদে পরীমনি কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তার সঙ্গে উচ্চবিত্ত ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কার কার সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে তা অকপটে বলতে শুরু করেন।
পত্রিকাটিতে বলা হয়, অভিযানের সময় পরীমনি সম্পদ নামের এক ব্যক্তি এবং পুলিশের একজন কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজনকে ফোন করেছিলেন। তাদের সাথে তার কী সম্পর্ক সেটাও জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। পরীমনি ছাড়াও ঢাকার একটি জাতীয় বাংলা দৈনিক ৫ আগস্ট খবর ছেপেছে যে, বসুন্ধরা এলাকা থেকে শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান (৩১) এবং তার সহযোগী মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসানকে (৩৯) আটক করেছে পুলিশ। এরা ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা চক্রের সদস্য বলে পত্রিকাটিতে বলা হয়েছে। এরা গুলশান, বারিধারা, বনানীসহ বিভিন্ন এলাকায় মাদক সেবনসহ অনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যবস্থা করে। এসব সমাজবিরোধী অনৈতিক কর্মকান্ডে সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সদস্যরা অংশগ্রহণ করে। কারা এই উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সদস্য?
দুই
৫ আগস্ট দৈনিক ইনকিলাবের অনলাইন সংস্করণে বলা হয়েছে, র্যাবের হাতে আরো আটক হয়েছে চিত্রনায়িকা আঁচল, শিরিন শিলা, মডেল নায়লা নাঈম, মডেল অহনা, শুভা, মানসী, পার্শা, মৃদুলা ও মৌরি। এদের পাশাপাশি কয়েকজন চিত্রনায়কও নাকি নিষিদ্ধ পর্নো ব্যবসায় জড়িত। এই তথ্য জানিয়েছেন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খাইরুল ইসলাম। ৫ আগস্ট দৈনিক যুগান্তরে বলা হয়েছে, ‘পরীমনির শরীর ঘনিষ্ঠদের তালিকায় আছেন পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আমলাসহ অনেক প্রভাবশালীর নাম। এদের কেউ কেউ পরীর সাথে দেশের বাইরে ঘুরতে যান। একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান তাকে হ্যারিয়ার গাড়ি উপহার দেন। চেয়ারম্যানকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ৬ আগস্ট শুক্রবার রাত ১১টায় অনলাইন সংস্করণে দেখলাম, পরীমনির কস্টিউম ডিজাইনার জিমিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়াও বিশিষ্ট নাটক সিনেমা নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরীকে একটি মার্কেট থেকে উঠিয়ে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়। সেখানে তাকে জেরার পর রাত দশটার দিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাকে বলা হয় যে, তিনি যেন ঢাকার বাই রে না যান। পুলিশ ডাকলেই যেন তাকে পায়।’
৭ আগস্ট শনিবার দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের রিপোর্ট মোতাবেক, ‘ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুনুর রশিদ বলেন, সমাজে যারা অবৈধভাবে টাকা আয় করে বিত্তশালী হয়েছেন, তাদের সন্তানেরা ঐসব নৈশ আসরে যাচ্ছেন। এরাই অনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছেন। সমাজের তথাকথিত বিত্তশালী, যারা মাদক কারবারের সাথে সংশ্লিষ্ট, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
৭ আগস্ট নিয়মিত প্রিন্ট মিডিয়ার অনলাইন সংস্করণে রিপোর্ট করা হয়েছে, পুলিশ, র্যাব ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে ২১ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে স্বর্ণ ব্যবসার সাথে জড়িত ৩ জন, পোশাকশিল্প ব্যবসার সাথে জড়িত ২ জন, রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ৬ জন, অন্যান্য ব্যবসার সাথে জড়িত ৬ জন, বিশেষ ২ ব্যক্তি, একটি বিশেষ বিষয়ে জড়িত ১ জন এবং ফার্নিচার ও প্লাস্টিক ব্যবসায় জড়িত ১ জন রয়েছেন। রাজধানীর তারকা হোটেল ও পার্টি হাউজে তাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এছাড়া ‘স্পা সেন্টার’সহ নামে বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আড়ালে গুলশান বনানীর ২৭টি স্থানে অনৈতিক কার্যক্রম চলত। সেখানেও এইসব প্রভাবশালীদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এছাড়া বনানীর অন্তত ১৩টি সিসা লাউঞ্জ ছিল তাদের অন্যতম আখড়া।
বাঘের ঘরে যদি ঘোঘ থাকে তাহলে সেই বাঘ তাড়ায় কার সাধ্য। উত্তরা বোট ক্লাবের মামলার তদন্ত অফিসার ছিলেন ডিবির এডিসি গোলাম সাকলায়েন। রাজারবাগের ‘মধুমতিতে’ তার সরকারি বাসভবন। প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক সেই বাসাতেও পরীমনি গিয়েছেন এবং একটানা ১৮ ঘণ্টা সময় কাটিয়েছেন। তদন্ত অফিসার গোলাম সাকলায়েন পরীমনির সাথে টানা ১৮ ঘণ্টা কী করেছেন? তদন্তের শুরুতেই গলদ। গোলাম সাকলায়েনকে ৭ আগস্ট ডিবি থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
তিন
এই ধরনের কদর্য কেলেঙ্কারি যখন মিডিয়ায় আসে তখন তার নানা ডালপালা গজায়। তিল যেমন তাল হয়ে যায়, তেমনি তালও অনেক সময় তিল হয়ে যায়। এবারও তেমনি তালকে তিল করার অপচেষ্টা চলছে। ৭ আগস্ট শনিবার একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্রধান সংবাদে বলা হয়েছে, অন্তত ২১ প্রভাবশালী ব্যক্তির ঘুম হারাম হওয়ার পথে। এখন তাদের অনেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে তদবির করতে মাঠে নেমেছেন। প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করছেন কেউ কেউ। মোবাইল ফোন বন্ধ করে এবং ফেসবুক আইডি নিষ্ক্রিয় করে তাদের অন্তত ৪ জন গা ঢাকা দিয়েছেন। আটক মক্ষীরানীরা স্বীকার করেছেন যে, ঐসব প্রভাবশালী ব্যক্তি জালনোট তৈরি এবং বেআইনি অস্ত্র ব্যবসায়েও জড়িত রয়েছেন। ডিবির জয়েন্ট কমিশনারেরর মতে, এদের অধিকাংশই খারাপ প্রকৃতির মানুষ। যারাই এগুলোর সাথে জড়িত ছিলেন বা আছেন তাদের সকলকেই গ্রেফতার করা হবে।
আলোচ্য পত্রিকাটির রিপোর্টের একটি অংশ উল্লেখের দাবিদার। বলা হয়েছে, অভিনেত্রী ও মডেলদের কেলেঙ্কারির ঘটনার এবার শেষ দেখতে চায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অনেক প্রভাবশালীর বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। তাদের সম্পর্কেও খোঁজখবর নিচ্ছে পুলিশ।
আমাদের সমাজ দেহ পচে গেছে। ভালো ও মন্দের পার্থক্য ঘুচতে চলেছে। আদর্শবোধ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতাবোধ প্রায় নির্বাসিত। টাকা চাই, টাকা। যেকোনো মূল্যে টাকা। সেটা সৎ অসৎ যে পথেই আসুক না কেন। আদর্শবোধের শিক্ষা কোথাও নাই। স্কুলে নাই, কলেজে নাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে নাই। আছে শুধু তাদের ওপরে ওঠার প্রতিযোগিতা। কে কাকে ল্যাং মেরে উপরে উঠবে সেই প্রতিযোগিতা। পাপ-পূণ্য বোধ নাই। মারি অরি পারি যে কৌশলে। মডার্ন হওয়ার প্রতিযোগিতা। ফাস্ট লাইফ (Fast life) লিড করার প্রতিযোগিতা।
দিল্লি বোম্বাইয়ের নগ্নতার সংস্কৃতি গ্রাস করেছে কলকাতাকে। সেই ঢেউ আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশে। মেয়েদের পিঠ উদোম রাখার ব্লাউজ ঢাকাতেও বেশ চোখে পড়ছে। ইন্ডিয়ার দেখাদেখি এদেশের তরুণ-তরুণীরাও আশা ভোশলের কণ্ঠে গীত গানটির মতো উচ্চকণ্ঠে গেয়ে উঠছেন, ‘বেশ করেছি, প্রেম করেছি, করবই তো/রাধার মতো মরতে হলে মরবই তো।’ এই নেশা, এই উন্মত্ততা আমাদেরকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে।
E-mail: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন