সুশিক্ষিত জাতি গঠনের কারিগর হিসেবে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, একশ্রেণীর শিক্ষকের অনৈতিক ও অর্থলিপ্সার কারণে তা ভূলুন্ঠিত হতে চলছে। প্রশ্ন উঠেছে তাদের দায়িত্ববোধ, আন্তরিকতা ও নৈতিকতা নিয়ে। এই শ্রেণীর শিক্ষক ক্লাসে পাঠদানের পরিবর্তে কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনেই বেশি মনোযোগী। তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত কোচিং সেন্টারে পড়তে বাধ্য করছেন শিক্ষার্থীদের। কোনো শিক্ষার্থী তা না করলে পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দেয়া, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনাও ঘটাচ্ছেন। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষকদের নিজেদের কারণেই তারা সম্মান হারাচ্ছেন। তারা ক্লাসরুম ছেড়ে আর্থিক লোভে চেম্বার কেন্দ্রিক কোচিং-এ মনোযোগী হয়ে উঠেছেন। কোচিং বাণিজ্য বন্ধে শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশ আমলে নিচ্ছেন না তারা। কোচিং-এর কুফল সম্পর্কে প্রবীণ শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড.সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, পরীক্ষা এখন বাণিজ্য হয়ে গেছে। টাকার বিনিময়ে সবকিছু হচ্ছে। কোচিং সেন্টার তুলে দিতে হবে। তিনি মনে করেন, ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসনির্ভর হতে হবে।
কোচিং সেন্টারের নামে শিক্ষাবাণিজ্য নিয়ে গত কয়েক বছরে অনেক লেখালেখি এবং সরকারের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করার পরও কেন কোচিং বাণিজ্য এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে তাই প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী বারবার কোচিং বাণিজ্য বন্ধের কথা বললেও তা বন্ধ হচ্ছে না। দৈনিক ইনকিলাবের রিপোর্টে বলা হয়েছে, শহর এলাকায় বিভিন্ন অলিগলিতে ছোট ছোট বাসাভাড়া নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে কোচিং সেন্টার। এসব কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন ও ব্যানার পোস্টারে থাকছে বেশ চটকদার এবং আকর্ষণীয় ঘোষণা। এমনকি এসব বিজ্ঞাপনে যেসব কৃতিত্বের কথা বলা হয় সেগুলো সর্বাংশে সত্য নয়। অভিযোগ রয়েছে, কোন কোন ক্ষেত্রে ভুয়া অথবা যাদেরকে তারা কোচিং দেননি অথচ মেধা মননে এগিয়ে রয়েছে এমন শিক্ষার্থীদের নামও ব্যবহার করা হয়। শিক্ষকদের বাসাবাড়িতে কোচিং দেয়া ছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামেও চলে কোচিং। এসব কোচিং-এর বাইরেও বর্তমানে প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বিশেষ কোচিং ফি নেয়া হচ্ছে। এজন্যও অভিভাবকদের বেশ বড় অংক গুনতে হচ্ছে। সন্তানের পড়াশোনার বিষয়টি কোনোভাবে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা বিবেচনায় নিয়ে অনেকটা বাধ্য হয়ে তারা কোচিং করাচ্ছেন। অন্যভাবে বলা যায়, এটি একটি ফ্যাশনেও পরিণত হয়েছে। অথচ মেধা তালিকা বা ফলাফলের বিবেচনায় দেশের মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক ভাল করলেও তাদের শিক্ষকদের তথাকথিত কোচিং বাণিজ্যের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে বর্তমান সময়ে যে ধরনের কোচিং বাণিজ্য চলছে আগে এসব ছিল না। তখন কোন শিক্ষার্থীর পাঠে কোন সমস্যা হলে সাধারণত সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ক্লাসের বাইরে তাকে সহায়তা দান করতেন। প্রাইভেট পড়ার একটা ব্যাপার কোন কোন বিষয়ে ছিল, তবে তাকে কোন বিবেচনাতেই বর্তমান কোচিং-এর সাথে মেলানো যাবেনা। চলমান কোচিং ব্যবস্থার আরো একটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে, এসব কেন্দ্রের বিনিয়োগকারীদের নেতৃত্বে প্রতিটি কোচিং কেন্দ্রকে ঘিরে একটি চক্র কাজ করছে। এসব কোচিং কেন্দ্রকে ঘিরে রয়েছে এক ধরনের আড্ডা যা কার্যত শিক্ষার চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক।
এক সময়ে মনে করা হতো, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নামমাত্র তাই তাদের বাড়তি আয়ের জন্য কোচিং ছাড়া কোন উপায় নেই। এখন শিক্ষকদের বেতন-ভাতা অনেক বাড়ানো হয়েছে। আরো বাড়ানো হবে। এতো সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরও শিক্ষকদের কেন কোচিং বাণিজ্যে লিপ্ত হতে হবে? ক্লাসে পাঠদান বাদ দিয়ে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যে ঝুঁকে পড়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। শিক্ষকরা কেন কোচিং বাণিজ্যে বেশি উৎসাহী, এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। আমরা মনে করি, শিক্ষাকে যারা পণ্যে পরিণত করেছেন তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। প্রতিটি স্কুলে এ ব্যাপারে নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুল কর্তৃপক্ষকেও ক্লাসে যথাযথ পাঠদানের বিষয়টি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদেরও মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন