গবেষণা সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর স্কুলগামী প্রায় ৭৭ ভাগ শিশু পর্নোগ্রাফি দেখে। অভিভাবকদের অসচেতনতা ও শিশুর প্রতি সঠিক আচরণে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতার অভাবই পর্নোগ্রাফির ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। সংস্থাটির জনৈক দায়িত্বশীল বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পর্নোগ্রাফির সঙ্গে সম্পর্কিত ২০০ শব্দের ওপর সংরক্ষণ দেয়া আছে। কেউ ওই শব্দগুলোর যে কোনোটি লিখে সার্চ দিলেই সার্ভারে নোটিফিকেশন যায়। অনুমোদন ছাড়া ওই সব সাইটে ঢোকা যায় না। বাংলাদেশেও এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া জরুরি। তিনি আরো বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া সিম নিবন্ধন করা নিষিদ্ধ। এর মানে আঠারো বছরের নিচে কাউকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে হলে অভিভাবকদের নামে নিবন্ধিত সিম ব্যবহার করতে হবে। অভিভাবকরা শিশুদের দামি মোবাইল ফোন, ট্যাব ও সেগুলোয় ইন্টারনেট সংযোগ দিচ্ছেন, কিন্তু তারা কী কাজে এগুলো ব্যবহার করছে সে সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখছেন না। এদিকে নজর দেয়া জরুরি। বিশ্লেষণে দেখা যাবে, সমাজে নানা কারণেই এখন শিশু-কিশোররা মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার সম্মিলিতভাবে যে সুরক্ষাটি জাতির ভবিষ্যৎ শিশু-কিশোরদের দিতে হয় নানা বাস্তবতায় বাংলাদেশে আজ তা অনেকটাই ভঙ্গুর। ফলে শিশুদের মাঝে মাদক গ্রহণ, মাদকাসক্তি থেকে শুরু করে ভিডিও গেমস, মোবাইল, ইন্টারনেট আসক্তি ইত্যাদি নেশার রূপ ধারণ করেছে। এর কুপ্রভাব যেমন শিশুদের পর্নোগ্রাফির প্রতি টানছে তেমনি তাদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে অস্থিরতা, সহিংসতা ও ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা। কাছাকাছি সময়ের মধ্যে কন্যা কর্তৃক পিতা-মাতা হত্যা, পুত্র কর্তৃক পিতাকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা যেমন আমরা দেখেছি ঠিক তেমনি দেখা যাচ্ছে ইভটিজিং, অশ্লীলতা ও পারিবারিক বিপর্যয়ের হাজারো ঘটনা। শিশু-কিশোর মনস্তত্ত্বের বৈকল্য থেকে তরুণ সমাজেও জঙ্গিবাদ ও বেপরোয়া মনোবৃত্তির বিস্তার ঘটছে। মুন্সীগঞ্জে মুক্তারপুর ব্রিজে রেলিং ভেঙে প্রাইভেট কার নিয়ে নদীতে পড়ে হারিয়ে যাওয়া তরুণ এ বেপরোয়াভাবেরই দৃষ্টান্ত।
বর্তমানে কারণে-অকারণে ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে আঘাত করা যেন মহামারীর আকার ধারণ করেছে। জাতীয় শিক্ষানীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, পাঠ্যসূচি ইত্যাদিতেও ধর্ম ও নৈতিকতার স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ করে কথিত প্রগতিশীলতার নামে ধর্মহীন শিক্ষার গোড়াপত্তন করা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের শ্লোগান দিয়ে অবাধ তথ্য প্রবাহ আর বিশ্বতথ্য মহাসড়কে সংযুক্তির জয়গান করা হলেও সীমালংঘন ও মন্দ বিষয় থেকে শিশু-কিশোরদের সুরক্ষার পবিত্র দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র ও সরকার যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থই হয়েছে। বিশ্বের বহু দেশে অনাকাক্সিক্ষত সাইটে প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার নিয়ম থাকলেও শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমান ও ৯৯.০৯ ভাগ ধর্মবিশ্বাসী, নৈতিকতাপ্রিয় জনগণের দেশ বাংলাদেশে কেন এ ধরনের নিয়মের বালাইও রাখা হয়নি, এ বিস্ময় রাখার জায়গা কোথায়। চীনে পর্নোগ্রাফি ব্যবস্থাপনা রয়েছে, সিঙ্গাপুরে রয়েছে নিজস্ব নীতিমালা, মালয়েশিয়ায় সমাজোপযোগী ফিল্টারিং ব্যবস্থা প্রবাদতুল্য। সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরব মুসলিম সমাজে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে সুনিপুণ নীতিমালা ঈর্ষণীয়। কিন্তু বাংলাদেশ যেন এ ক্ষেত্রে সচেতনভাবেই নজিরবিহীন অনিয়ম ও নৈরাজ্য ধরে রেখেছে। জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেয়ার যদি কোনো প্রয়াস বাংলাদেশ-বিদ্বেষী কেউ গ্রহণ করে থাকে সরকার তাকে প্রতিহত করা তো দূরের কথা, মনে হয় যেন সরকারও বুঝে না বুঝে তার হাতকেই শক্তিশালী করছে। শতবার প্রার্থনা করি, আমাদের এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হোক। এ বিষয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের উদ্যোগ ও আন্তরিকতা আরো বহু গুণ বৃদ্ধি পাক।
শিশু-কিশোরদের এ বিপজ্জনক বৃত্ত থেকে বের করা এবং নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করতে অভিভাবকদের যেমন সতর্ক হতে হবে, সমাজকেও হতে হবে সচেতন। সামাজিক অনুশাসন, আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ এবং পরিবারের আন্তরিকতা ও দক্ষতাই পারে আলোচ্য সমস্যার সমাধান করতে। ধর্মীয় শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা ও ধর্মীয় অনুশাসনের পরিপালনই এ ধরনের কঠিন সমস্যার পরীক্ষিত প্রতিষেধক। সরকার ও সমাজের উচ্চপর্যায় থেকে এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সমাজজীবনে পুনস্থাপন করতে হবে। পরিবারকেও তার মহান দায়িত্ব পালনে নতুন করে ভাবতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর ভবিষ্যৎ তথা শিশু-কিশোরদের নতুন প্রযুক্তির ভুল প্রয়োগ ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার থেকে রক্ষার যথাযথ পথ-পদ্ধতি এবং নীতি-নিয়ম গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্টদের খুব দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় অভিভাবক, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকার কেউই জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংসের দায় এড়াতে পারবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন