শুক্রবার, ২৪ মে ২০২৪, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের কৃষি নির্ভর অর্থনীতি

রংপুর থেকে হালিম আনছারী | প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০২১, ৫:৪৭ পিএম

মহামারী করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের কৃষি নির্ভর অর্থনীতি। মহামারী করোনার ভয়াবহতা আর দফায় দফায় লকডাউনে স্থবির হয়ে যায় সবকিছু। ভেঙ্গে পড়ে গোটা দেশের পরিবহন ব্যবস্থা। যার প্রভাব পড়ে এ অঞ্চলের কৃষি এবং কৃষকের ওপর। বাম্পার ফলন হলেও উৎপাদিত পণ্য সঠিক সময়ে পাইকারি বাজারে পৌঁছাতে না পারায় দ্রুত পচনশীল ফসল নষ্ট হয়ে যায় এবং কমদামে বিক্রি করতে হয় স্থানীয় বাজারে। এতে করে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন এ অঞ্চলের কৃষকরা। ঋণের বোঝা বেড়েছে অনেকেরই।
বাংলাদেশের অন্যতম শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চল। দিনাজপুরের চাল-ডাল আর রংপুরের সব্জি স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়েও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারী বাজারে যেত। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, এ অঞ্চলের শাক-সবজি দেশের ৪০ ভাগ চাহিদা পূরণ করে থাকে। চাল, ডাল, সব্জি ছাড়াও মওসুমি ফল বিশেষ করে আম ও লিচু এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিরাট ভুমিকা রাখে। শুধুমাত্র এ দু’টি ফল থেকেই প্রতিবছর এ অঞ্চলের কৃষকদের হাতে আসে কয়েক ’শ কোটি টাকা। যা এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। সব্জির পাশাপাশি এ অঞ্চলের আম এবং লিচুর চাহিদা দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও চাহিদা বাড়তে থাকে দিন দিন। মাত্র কয়েক ২/৩ বছরের মধ্যেই চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুন। ফলে এ অঞ্চলের কৃষকরাও এর প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন এবং এর চাষাবাদে ঝুঁকে পড়েন। আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় চলতি বছর এ অঞ্চলের সর্বত্রই চাল, ডাল ও গ্রীস্মকালীন সব্জিসহ মওসুমি ফল আম ও লিচুর ফলন ভালো হয়। মাঠ ভরা ফসলের ক্ষেত আর ফলে ফলে ভরা গাছ কৃষকদের কৃষকদের মন ভরিয়ে দেয়। হাসি ফুটে ওঠে কৃষকদের মুখে। কিন্তু ভরা মওসুমে ফসল ঘরে তোলার শুরুতে এসে কৃষকদের এ হাসি মলিন হয়ে যায়। মরণঘাতি করোনা’র দ্বিতীয় ঢেউ তছনছ করে দেয় কৃষকের স্বপ্ন। দফায় দফায় লক ডাউন আর পরিবহন ব্যবস্থাই পঙ্গু করে দেয় কৃষকদের। বিশেষ করে পরিবহন ব্যবস্থা স্বাভাবিক না থাকায় উৎপাদিত পণ্য দ্বিগুন-তিনগুন ভাড়ায় বাইরের পাইকারী বাজারে পাঠাতে হয়। এভাবে দ্বিগুন-নিতনগুন ভাড়ায় পণ্য পাঠিয়ে লাভবান না হলেও অনেকেই আসল পুঁজি ওঠানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু অনেকের পক্ষেই তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বিশেষ করে প্রত্যন্ত পল্লী এলাকার কৃষকদের পক্ষে একেবারেই সম্ভব হয়নি। ফলে স্থানীয় বাজারে কিংবা ফড়িয়াদের কাছে পানির দামে বিক্রি করতে হয় উৎপাদিত পণ্য। আবার অনেক ক্ষেত্রে পরিবহনের অভাবে দ্রুত পঁচনশীল ফসলগুলোও সময় মত বাজারে পৌঁছাতে না পারায় সেগুলো ক্ষেতে কিংবা কৃষকের বাড়িতেই নষ্ট হয়ে যায়।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এবার সব সবজিতেই ভালো ফলন পেয়েছেন তারা। কিন্তু গত দুমাস ধরে দফায় দফায় লকডাউনের কারণে সবজি রংপুরের বাইরে পাঠাতে পারেননি। প্রতিটি পণ্যের দাম দাম পড়ে গেছে। কৃষক ১৫০ টাকা মনে কাকরোল, বরবটি ৩০০-থেকে ৩৫০ টাকা মন প্রতি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।সীম, বেগুন পটল ও ঢেড়শ উৎপাদনে খরচ ১০ থেকে ১২ টাকা হলেও বিক্রি করতে হয়েছে ৬-৮ টাকায়। রংপুরের পদাগঞ্জ এলাকার আম চাষী মোজাম্মেল জানান। এ অঞ্চলের বিখ্যাত হাঁড়িভাঙ্গা আম দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে যেত। আমের মওসুমে এই হাটে প্রতিদিন লোকে লোকারন্য থাকত। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মওসুমি ব্যবসায়ীরা আসতেন আম কিনতে। এবারে লকডাউনের কারনে কোন জায়গা থেকেও লোক আসেননি। পরিবহন ব্যবস্থা স্বাভাবিক না থাকায় দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে টুকটাক আম ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। কিন্তু লকডাউনের কারনে ঢাকায় কুরিয়ার থেকে আম নিতে সমস্যা হওয়ায় অনেকেই আম কেনেন নি। যে সময়ে আম কেজি প্রতি ৬০ থেকে ৭০ টাকা বিক্রি হত, সেখানে ওই সময় আম বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে। লকডাউনের কারনে বিদেশে তো নয়ই, দেশের অন্যান্য স্থানেও পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তিনি জানান, তার ৩টি আম বাগান থেকে গত বছর পেয়েছিলেন ১৫ লক্ষ টাকা। এবছর ফলন বেশি হওয়ার পরও তিনি ওই ৩টি বাগান থেকে আম বিক্রি করতে পেরেছেন মাত্র সাড়ে ৪ লাখ টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, মধ্য এপ্রিল থেকে মে মাস জুড়ে বোরো ধান কর্তন ও সংগ্রহের কাজে কৃষকদেরকে মাঠে ব্যস্ত থাকতে হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলে বোরো ধান কর্তন। এর মাঝেই গ্রীষ্মকালীন ফল, গ্রীষ্মকালীন সবজি ঘরে আসতে থাকে। মোটামুটি চলে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত। বেশ কয়েক বছর ধরেই এ অঞ্চলের শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন সবজি ভালো হচ্ছে। এখানকার সবজি স্থানীয় চাহিদা পুরণ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। এতে করে এ অঞ্চলের কৃষি নির্ভর অর্থনীতি অনেক চাঙ্গা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই এ অঞ্চলের মওসুমি ফল বিশেষ করে রংপুর, নীলফামারী ও ঠাকুরগাঁওয়ের আম এবং দিনাজপুরের লিচু এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং বেশ সমৃদ্ধ করেছে কৃষি নির্ভর অর্থনীতিকে। কিন্তু মহামারী করোনা এবার এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে তছনছ করে দিয়েছে। ভরা মওসুমে কৃষক, ব্যবসায়ী, ভোক্তাসহ সবাইকে ঘরে বন্দি থাকতে হয়েছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পন্য ঠিকভাবে বাজারে নিতে পারেনি, ব্যবসায়ীরা কিনতে বা পরিবহন করতে পারেনি, আর ভোক্তারা খেতে পারেননি। এতে করে সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকরা। যার প্রভাব অনেকটাই পড়বে আসন্ন রবি মওসুমেও।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন