কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরে ভূতুড়ে কৃষকের কাছ থেকে চলতি বোরো মৌসুমে ধান-গম সংগ্রহ করার অভিযোগ উঠেছে। খাদ্য গুদামের কতিপয় কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী মিলে তৈরি হয়েছে সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে লটারীতে নাম ওঠা প্রকৃত কৃষকের জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে ধান-গম ক্রয় করে ৫৯ লাখ ৯৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে উলিপুর খাদ্য গুদামের ইনচার্জ শাহীনুর রহমান। আর ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিয়েছে কোটি টাকার লাভ।
কৃষক মোহসীন আলী, আকবর আলী, সাইফুল ইসলাম ও বাবুল লিখিত অভিযোগে বলেন, খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা শাহীনুর রহমান উলিপুরে যোগদানের পর থেকে সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে চলতি বছরে বোরো ধান-চাল ও গম সংগ্রহের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আর তাকে এ কাজে সহযোগিতা করার জন্য গড়ে তুলেছেন একটি সিন্ডিকেট চক্র।
খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা শাহীনুর রহমানের যোগসাজশে মিল মালিক সমিতির আহবায়ক মাহফুজার রহমান বুলেট, সাবেক উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হেমন্ত বর্মনের কথিত ভাগ্নে গাইবান্ধা জেলার বাসিন্দা সুমন মিয়া ও মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুল মজিদ হাড়ির ভাতিজা ধামেশ্রনী ইউনিয়নের স্বাস্থ্য সহকারী মিজানুর রহমানসহ কয়েকজনকে নিয়ে সিন্ডিকেট চক্র গড়ে তুলেছেন।
অভিযোগকারীদের তথ্য মতে, ওসিএলএসডি শাহিনুর রহমান প্রতি টন ধানে ২ হাজার, গমে দেড় হাজার এবং চালে টন প্রতি ২ হাজার টাকা উৎকোচ নেন। এ হিসাবে ধানে ৩০ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, গমে ৪ লাখ ১৭ হাজার টাকা এবং চাল ক্রয়ে ২৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা অর্থাৎ ৫৯ লাখ ৯৩ হাজার টাকা আয় করেন। তারা আরও বলেন, প্রকৃতপক্ষে ৬শ’ মেট্রিক টন ধান খাদ্য গুদামে মজুদ থাকলেও কাগজে কলমে ১৫শ’ ৪৩ মে. টন দেখানো হচ্ছে। বাকি ধান কয়েকটি মিলের সঙ্গে ছাটাইয়ের চুক্তি করে অগ্রিম বিল প্রদানের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সিন্ডিকেট চক্রের সক্রিয় সদস্য মিল মালিক সমিতির আহবায়ক মাহফুজার রহমান বুলেটের নিজস্ব নামে কোন মিলের লাইসেন্স নেই। তিনি তার পিতার মালিকাধীন পৌরসভার নাড়িকেল বাড়ি গ্রামের সরকার চাল কলের প্রতিনিধিত্ব করেন। অপর সদস্য সুমন মিয়া কুড়িগ্রাম জেলার বাসিন্দা নন। তিনি পান্ডুল ইউনিয়নে থাকা চাঁন চাল কল, মালিক চাঁন মিয়ার মিল ভাড়ায় নিয়ে তার প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেন। এছাড়া মিজানুর রহমান মেসার্স আছমত চাল কলের প্রতিনিধিত্ব করেন।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, ধান সংগ্রহের লটারীতে উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের ৯৬নং ক্রমিকে পানাতিপাড়া গ্রামের ভেলু মামুদের ছেলে খেলু মামুদ নামে এক কৃষক গত ১৮ জুন উলিপুর খাদ্য গুদামে ১ মে. টন ধান দিয়ে বিল উত্তোলন করেছেন (গুদামের রেজিস্ট্রারে ৪১২নং ক্রমিকে বিল নম্বর-৫৫৫)। অথচ খেলু মামুদের স্ত্রী লতিফা বেওয়া দাবি করে বলেন, তার স্বামী চলতি বছরের ১৯ মার্চ মৃত্যুবরণ করেছেন। এদিকে ওই মৃত কৃষকের নাম ও পিতার নাম ঠিক রেখে জাতীয় পরিচয় পত্র নম্বরে ১২ সংখ্যা ব্যবহার করে ছবি, মাতার নাম, গ্রামের নাম পরিবর্তন করে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়। এর মাধ্যমে সরকারি গুদামে ধান প্রদান ও বিল উত্তোলন করা হয়।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, উপজেলার বজরা ইউনিয়নে ৪ জন কৃষকের কাছ থেকে গত ১০ জুন ৪ মে. টন ধান সংগ্রহ দেখিয়ে ব্যাংক থেকে বিল উত্তোলন করা হয়েছে। তারা হলেন, মুন্সিপাড়া গ্রামের জব্বার আলীর ছেলে আলম মিয়া (বিল নং-২৯৪), মমফার আলীর ছেলে মনজু মিয়া (বিল নং-২৯৩), বাহার প্রধানের ছেলে আনোয়ার হোসেন (বিল নং-২৯২) এবং নাপিতপাড়া গ্রামের আব্বাস আলীর ছেলে মকবুল হোসেন (বিল নং-২৯১)। এই ইউনিয়নেও কৃষকের নাম ও পিতার নাম ঠিক রেখে জাতীয় পরিচয় পত্র নম্বরে ১২ সংখ্যা ব্যবহার করে ছবি, মাতার নাম, গ্রামের নাম পরিবর্তন করে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়। একই ভাবে সরকারি গুদামে ধান প্রদান ও বিল উত্তোলন করা হয়। বজরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম আমীন ওই ইউনিয়নে মুন্সিপাড়া ও নাপিতপাড়া নামে কাগজ কলমে কোন গ্রামের অস্তিত্ব নেই বলে নিশ্চিত করেছেন।
লটারীতে নাম থাকা ধামশ্রেণীর ইউনিয়নের ভদ্রপাড়ার গ্রামের কৃষক উপেন চন্দ্র বর্মন বলেন, আমি ৪০ মণ ধান বিক্রি করেছি বাজারে। উলিপুর খাদ্য গুদামে কোন ধান দেই নাই। অথচ তার নাম ব্যবহার করে খাদ্য গুদামে ধান সংগ্রহ দেখিয়ে বিল উত্তোলনের মতো উদ্বেগজনক তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম রাকিব জানান, অভিযুক্ত জাতীয় পরিচয়পত্র গুলো পরীক্ষা করে দেখলাম এ সব গুলোই ভুয়া।
উপজেলা খাদ্য গুদাম সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি ২৭ টাকা দরে ২৬শ’ ৩৫ মে. টন ধান, প্রতি কেজি ২৮ টাকা দরে ২শ’ ৭৮ মে. টন গম ও প্রতি কেজি ৪০ টাকা দরে ১৪শ’ ৩৫ মে. টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু গুদাম কর্মকর্তা শাহীনুর রহমানের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ধান ক্রয়ের শেষ তারিখ ১৬ আগস্ট থাকলেও দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ হলে ২ আগস্ট থেকে ধান সংগ্রহ বন্ধ হয়ে যায়। ২ আগস্ট পর্যন্ত ৯৬২ জন কৃষকের কাছ থেকে মাত্র ১ হাজার ৫৪৩ মে. টন ধান সংগ্রহ করা হয়।
অপরদিকে জুন মাসে ২৭৮ জন কৃষকের কাছ থেকে ২৭৮ মে. টন গম সংগ্রহ করা হয়। উপজেলার ৭২টি মিল মালিকের কাছ থেকে ১ হাজার ৪৩৫ মে. টন চাল লক্ষ্যমাত্র থাকলেও সংগ্রহ হয়েছে ১ হাজার ২৪৫ মে. টন। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ মিল মালিকের চাতাল গুলো পরিত্যক্ত। তারা গুদাম কর্মকর্তার সাথে যোগসাজশে গুদাম থেকে অগ্রিম বিল উত্তোলন করে বাইরের জেলা থেকে চাল ক্রয় করে গুদামে সরবরাহ করেছেন।
এ ঘটনায় স্থানীয় ব্যবসায়ী ও কৃষকরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ করলেও মেলেনি প্রতিকার। অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতা নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তুলেছেন স্থানীয় সাংসদ প্রিন্সিপাল এমএ মতিন
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূর-এ-জান্নাত রুমি জানান, অভিযোগ হাতে আসেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যাবস্থা নেয়া হবে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু বকর বলেন, জাল এনআইডি কিংবা ভুয়া কৃষকের নিকট হতে ধান,গম সংগ্রহের কোন লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ পাইনি। পেলে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন