আমার প্রথম জন্মদিন ছিলো ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর। মায়ের মুখে শুনেছি বাবা ঢাকা থেকে নতুন জামা নিয়ে আসবে। নতুন পোশাক পড়ে ধুমধাম করে আমার প্রথম জন্মবার্ষিকী পালন করা হবে। কিন্তু বাবা আর ফিরে আসেননি। ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আমার বাবা মারা যায়। তখন হয়তো কিছুই বুঝিনি। আস্তে আস্তে বড় হবার পর সব বুঝতে পেরেছি। এ বছর ১ সেপ্টেম্বর আমার ১৭ বছর পূর্ণ হবে। কিন্তু এতো বছর পার হলেও বাবাসহ হতাহতদের অকাল মৃত্যুর বিচারের রায় হলেও তা এখনোও কার্যকর হয়নি। তাই সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপরাধীদের বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর করার। তাহলে এ ঘটনায় আমার বাবাসহ যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের আত্মা শান্তি পাবে। এভাবে কথাগুলো বললেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের যুবলীগ নেতা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত লিটন মুন্সির মেয়ে নুসরাত জাহান মিথিলা।
শুধু মিথিলার পরিবার নয়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত শেখ হাসিনার সমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় মাদারীপুরের নিহত ৪ পরিবারসহ আহত ৩ পরিবারের সদস্যরা ভালো নেই। একই ঘটনায় আহতরা পঙ্গুত্ব নিয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় মাদারীপুরের নিহত ৪ জন হলো, রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের যুবলীগ নেতা নিহত লিটন মুন্সি, একই উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের মহিষমারি গ্রামের সুফিয়া বেগম, কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের রামারপোল গ্রামের নাছিরউদ্দিন ও ক্রোকিরচর গ্রামের যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহাম্মেদ ওরফে কালা সেন্টু। আহতরা হলেন, কালকিনি পৌরসভার বিভাগদি গ্রামের হালান হাওলাদার, কৃষ্ণনগর গ্রামের কবির হোসেন, ঝাউতলা গ্রামের সাইদুল হক সরদার।
খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের যুবলীগ নেতা নিহত লিটন মুন্সির মা আছিয়া বেগম ও বাবা আইয়ুব আলী মুন্সি তাদের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আজও তারা কষ্টে দিন কাটায়।
নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মিথিলা প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকা করে ভাতা পাচ্ছে। এছাড়াও ঢাকার মিরপুরে একটি ফ্ল্যাট বাসা ও ২০১৮ সালের রোজার সময় ৫ লাখ টাকা সরকারিভাবে পেয়েছে। তাই সরকারের কাছে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে দ্রæত বিচারের দাবি করেছেন।
নাসিরের বড় ছেলে মাহাবুব হোসেন জানান, বাবার উপার্জনেই চলতো সংসার। বাবার মৃত্যুর পর টাকার অভাবে আমাদের লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কোন কোনদিন অর্ধপেট আবার কোনদিন খাবারই জোটেনি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন। এখন সেই টাকার লভ্যাংশ দিয়ে আমার মা, আমি আর আমার ভাই নাজমুলকে নিয়ে কোনরকম বেঁচে আছি। এছাড়া আমাদের খবর আর কেউ রাখেনি।
গ্রেনেড হামালায় নিহত যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহাম্মেদ ওরফে কালা সেন্টু। তার বাড়ি কালকিনি উপজেলার ক্রোকিরচর। কথা হয় সেন্টুর স্ত্রী আইরিন সুলতানার সাথে। তিনি ঢাকার মার্কেন্টাইল ব্যাংকে চাকরি করেন। এক মেয়ে আফসানা আহমেদ রীদিকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। তিনি বলেন, মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় থাকি। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছিলাম। সে সম্বল আর চাকরি থেকে যা পাই, তা দিয়েই মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাবছি।
হালান হাওলাদার বলেন, শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর স্প্রিন্টার রয়েছে। স্প্রিন্টার জ্বালা-যন্ত্রণা অসহ্য লাগে মাঝে মাঝে। হাটাচলা করতে খুব কষ্ট হয়। সে কারণে তেমন কাজ করতে পারি না। তারপরেও সংসারের খরচ মেটানোর জন্য ফেরি করে মুরগি বিক্রি করি। আহত অনেকে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ফ্ল্যাট পেয়েছে। আমি পাইনি।
আহত কবির হোসেন বলেন, গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়ে বাম হাতের ৫ আঙ্গুল বাকা হয়ে আছে। এ হাত দিয়ে কোন ভারি কাজ করতে পারি না। দুইবার আমি মাত্র এক লাখ ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে যে টাকা দিয়েছে আমি সে টাকা পাইনি। তখন আমি টাকা রোজগারের জন্য মালায়েশিয়া ছিলাম। বিদেশে গিয়েও হাতের সমস্যার কারণে তেমন কাজ করতে পারিনি। বাধ্য হয়ে দেশে চলে।
কালকিনির ঝাউতলা গ্রামের সাইদুল হক সরদার বলেন, স্পিন্টারের যন্ত্রনায় তেমন ভারি কাজ করতে পারছি না। ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার বলে উন্নত চিকিৎসা দরকার। আমি উন্নত চিকিৎসা কিভাবে করবো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই তিনি যেন আমাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ছোট একটা চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন