বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার মামলার দুই আসামি নিজেদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছে। গতকাল রোববার ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালতে আসামি মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন এবং বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল সাফাই সাক্ষ্য দেন। আজ মামলাটির সাফাই সাক্ষ্যের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
সাফাই সাক্ষী দেয়ার সময় জিয়ন আদালতে বলেন, এই মামলার অন্য কোনো আসামির সঙ্গে তার কোনো যোগসাজস ছিল না। মামলার ঘটনাকালীন সময় সে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের মেস ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিল। ঘটনার দিন সকল দায়িত্ব পালন শেষে হলে ছিল সে। ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর রাতে সে তার কক্ষে যাওয়ার সময় বুয়েটের কয়েকজন ছাত্র, কয়েকজন পোশাকধারী এবং সাদা পোশাকে পুলিশ দেখতে পায়। ছাত্রদের মধ্য থেকে একজন তাকে দেখিয়ে পুলিশকে ইঙ্গিত করে। একজন পুলিশ অফিসার তাকে জিজ্ঞাসা করেন, সে ছাত্রলীগ করে কি না? উত্তরে জিয়ন জানায়, হ্যাঁ সে ছাত্রলীগের কর্মী। তখন তিনি তাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলেন। তাকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে একটি সেলে আটকে রাখা হয়। এরপর জামিল নামে একজন অফিসার তার কাছে আবরারের মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। আবরার নামে কাউকে সে চিনে না এবং কোনোদিন দেখেনি। তখন জামিল রেগে গিয়ে তার পায়ে আঘাত করেন, কিল-ঘুষি ও চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন— তখন সে খুব অসুস্থ বোধ করে। এর পরদিন তাকে আদালতে নেয়া হয়। আদালত তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ড দেয়। এরপর বিগত ২০১৯ সালের ৮ অক্টোবর রাজিব নামে এক অফিসারের রুমে তাকে নেয়া হয়। তিনিও তাকে আবরারের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। সে একই উত্তর দিলে তিনি তাকে চড়-থাপ্পড় ও কিল-ঘুষি দিয়ে গলা চেপে ধরে দেয়ালের দিকে ছুড়ে মারেন। এতে সে পড়ে যায়। এরপর আবার পরদিন তাকে রাজিব সাহেবের রুমে নেয়া হয়। সেখানে তাকে প্রচুর মারপিট ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়। খাবার-দাবার এমন কি পানি পর্যন্ত তাকে দেয়া হয় না। এতটাই মারপিট করা হয় যে, সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বা হাত-পায়ের যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পর্যন্ত পারেনি। এরপর তার চোখ এবং হাত-পা বেঁধে সেল থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে তার বুকের ওপর চাপ দিয়ে মাথায় একটি নল ঠেকিয়ে বলা হয়, সে যদি কথামত কাজ না করে, তাহলে তাকে ক্রস ফায়ার দেয়া হবে। আজকেই হবে তার জীবনের শেষ দিন। আর যদি কথামত কাজ করিস তাহলে আর টর্চার করা হবে না। খাবার, ওষুধ সব পাবি। তখন সে জীবন বাঁচাতে খাবার ও ওষুধ পাওয়ার জন্য তাদের কথায় রাজি হয়।
এরপর তার হাতের ও পায়ের বাঁধন খুলে অন্য এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে তার চোখের বাঁধন খুলে দিলে সে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওয়াহিদুজ্জামানকে দেখতে পায়। তিনি কিছু কাগজে তাকে স্বাক্ষর করতে বলেন। সে ভয়ে স্বাক্ষর করে। এরপর বলেন, কাল যেখানে নিয়ে যাব সেখানে গিয়ে একই কথা বলতে এবং একই কাজ করতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেটকে যদি বলে যে, আবরার হত্যার বিষয়ে জানে না, তাহলে তাকে আবার রিমান্ডে নিয়ে ক্রস ফায়ার দেয়া হব। চার-পাঁচ দিন এভাবে রাখার পর তাকে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে আসা হয়। সেখানে এনে আইও সাহেবের প্রিন্ট করা একটি কাগজ দেখে ম্যাজিস্ট্রেট আবার প্রিন্ট করেন। তারপর তাকে স্বাক্ষর করতে বলা হয়। সে ভয় পেয়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর করে।
অপর আসামি মেহেদী হাসান রাসেল তার সাক্ষ্যে বলেন, ঘটনার দিন সে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাস্থলে গিয়েছিলেন। এই ঘটনা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি সবকাজ শেষে হলে নিজের কক্ষে ঘুমিয়ে ছিলেন। রাত ৩টা ২০ মিনিটের সময় একজন ছাত্র এসে জানায়, একটি ছেলেকে কারা যেন পিটিয়েছে, খুব সমস্যা হয়েছে। সে তাৎক্ষণিক সেখানে ছুটে যান, গিয়ে দেখে একটি নিথর দেহ পড়ে আছে, পাশে ডাক্তার দাঁড়িয়ে রয়েছে। এরপর সকাল সাতটার দিকে সে চকবাজার থানায় যায়, থানা পুলিশ তাকে আটক করে।
পরদিন তাকে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে আদালতে আনা হয়, আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড দেন। তাকে কিছুই জিজ্ঞাসাবাদ না করে চার-পাঁচ দিন পরে তাকে আবার আদালতে আনা হয়। আদালত তাকে কেরানীগঞ্জের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। এই ঘটনার আদ্যোপান্ত কিছুই জানে না। ঘটনার ওইদিন রাত ৩টা ২০ মিনিটের পূর্বে তার কোনো ভিডিও ফুটেজ কোথাও পাওয়া যাবে না। এরপর প্রমাণ হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের সভাস্থলে থাকার ছবি আদালতে জমা দেন মেহেদী হাসান রাসেলের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে আসামিরা। এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরের দিন ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন