শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবন ১৪৩১, ২০ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

সম্পাদকীয়

আবরার হত্যা মামলার রায়

| প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০২১, ১:০৫ এএম

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায়ে ২০ জনের মৃত্যুদন্ড ও ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। বিচারিক রায়ে দন্ডপ্রাপ্তদের সকলেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ড সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডগুলোর অন্যতম। ২০১৯ সালের অক্টোবরে ভারতের সাথে কথিত অসম পানিচুক্তির সমালোচনা করে দেয়া ফেইসবুক স্ট্যাটাসের জেরে শিবিরকর্মী সন্দেহে ত্বরিৎ প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে বুয়েটের শেরেবাংলা হল শাখা ছাত্রলীগ শাখার নেতা-কর্মীরা পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের আদ্যপান্ত অনেক কিছুই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল। রাজধানীর চকবাজার থানায় আবরার ফাহাদের পিতার দায়ের করা মামলাটি প্রায় এক বছরের তদন্ত শেষে গত বছর ১৩ নভেম্বর ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে নির্মমভাবে পিটিয়ে আবরার ফাহাদকে হত্যা করে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল। বুয়েটের হলে আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ড দেশের মানুষকে বিক্ষুব্ধ ও হতবাক করেছিল। এ হত্যাকান্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি ছিল দেশের সব মানুষের কাক্সিক্ষত ও প্রত্যাশিত। ঢাকা সিএমএম কোর্টের ট্রাইবুনাল-১ এর বিচারক আবুজাফর মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের এই রায়ে ন্যায়বিচার ও জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) দেশের উচ্চতর বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম। সারাদেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই এখানে ভর্তির সুযোগ পান। এখান থেকে পাশ করে একেকজন ইঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞানের মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু উচ্চতর ডিগ্রিধারী, দক্ষ পেশাজীবী মানুষই তৈরি করে না, দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করার অনুপ্রেরণা ও মানবিক মানুষ হিসেবে সামাজিক দায়িত্ব পালনের শিক্ষাও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সংঘটিত ঘটনাবলী এবং আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে যে অবক্ষয়ের চিত্র দেখা যাচ্ছে, তাতে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার লক্ষ্য অর্জনে অনেকটাই ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর বল্গাহীন ছাত্র রাজনীতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো সন্ত্রাস-নির্মমতা ও হত্যাকান্ডের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা এবং সব রাজনৈতিক-দার্শনিক মত প্রকাশের মুক্তমঞ্চ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা থাকলেও তা এখন একদলীয় ছাত্র রাজনীতির নৈরাজ্যে পরিণত হয়েছে। গত এক দশকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে অন্তত ২৪ জন শিক্ষার্থী নিমর্ম হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। এর বেশিরভাগই সংঘটিত হয়েছে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে। আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ড মামলার রায়ে ২৫ জন ছাত্রলীগ কর্মী সর্বোচ্চ শাস্তির সম্মুখীন হয়েছেন। ইতিপূর্বে চাঞ্চল্যকর বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ড মামলার রায়ে ২১ আসামির মধ্যে ৮ জনের মৃত্যুদন্ড এবং ১৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় দিয়েছিল বিচারিক আদালত। তবে সে রায়ের পর ইতোমধ্যে ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও রায় বাস্তবায়িত হয়নি। আসামিদের অনেকে এখনো পলাতক রয়েছে। এ দৃষ্টান্ত সামনে রেখে আবরার ফাহাদ হত্যার রায়ের বাস্তবায়ন নিয়েও অনেকে এমন সংশয় প্রকাশ করেছেন।

আবরার হত্যা মামলার রায় হন্তারকদের জন্য একটি চরম বার্তা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। একজন নিরপরাধ সহপাঠি শিক্ষার্থীকে মিথ্যা অভিযোগে পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনা যেন আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে না ঘটে- এ রায়ের মধ্য দিয়ে সেই বার্তাই দেয়া হয়েছে। প্রতিটি জীবনই মূল্যবান এবং কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। অনৈতিক, ক্ষমতাদর্পি রাজনীতি যখন ছাত্র রাজনীতিকেও গ্রাস করে, তখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটি হত্যাকান্ড একেকটি পরিবারের জন্য ঘোর অন্ধকার এবং স্বপ্নের অপমৃত্যু। উন্নততর মানুষ গড়ার পীঠস্থান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবচেয়ে নিরাপদ ও আলোকিত স্থান হওয়ার বদলে যারা ক্যাম্পাসগুলোকে বিভীষিকাময় করে তুলেছে তারা বিচারের বাইরে থাকতে পারে না। সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সব হত্যাকান্ড ও সন্ত্রাসী ঘটনার সাথে জড়িত সকলকেই আইনের আওতায় আনতে হবে। আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ডে শেরেবাংলা হলের ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা দন্ডিত হলেও, এর পেছনের নেপথ্যের কুশীলব বা নির্দেশদাতারা বিচারের বাইরে রয়ে গেলেন কিনা তা’ও খুঁজে দেখা দরকার। তাছাড়া শুধু দু’একটি চাঞ্চল্যকর মামলায় দন্ড দিয়েই এমন নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা রোধ করা যাবে না। সব হত্যাকান্ড যেমন চূড়ান্ত বিচারের কাঠগড়ায় আসে না, আবার দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ায় মামলার চূড়ান্ত পরিণতিতে অনেকেই নানাভাবে খালাস পেয়ে যাওয়ার কারণে হন্তারকরা বেপরোয়া হয়ে উঠতে ভয় পায় না। আমাদেরকে এসবের মূলে হাত দিতে হবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক মানদন্ডে উন্নীত করার বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোকে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি ও কোনো পক্ষের আধিপত্যবাদী অবস্থান থেকে মুক্ত রাখতে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন