শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা নিয়ে আমরা কতটুকু সচেতন?

তৌহিদুর রহমান তুহিন | প্রকাশের সময় : ২৪ আগস্ট, ২০২১, ১২:০৩ এএম

করোনা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করছে এবং আক্রান্ত হচ্ছে কয়েক হাজার করে। বর্তমানে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট-এ সংক্রমণের হার পূর্বের যে কোন ভ্যারিয়েন্ট থেকে বেশি। যার প্রভাব সারা দেশেই পড়েছে। এই অবস্থায় সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে সংক্রমণ হার কমানোর জন্য। চলছে টিকা কার্যক্রম। সম্মুখ সারির কোভিড সেবাদানকারী থেকে শুরু করে জনসাধারণকে টিকা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে কাজ করছে সরকার। এর মধ্যেই দুয়ারে এসে হাজির হয়েছে ডেঙ্গু।

গত বেশ কয়েকদিন যাবত বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে মানুষ। সেই সংখ্যা প্রতিদিন ধীরে ধীরে বাড়ছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সবার চোখ এখন কোভিড এর দিকে। ফলে, অনেক মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে কোনো প্রকার চিন্তাই করছে না, যা আমাদের ভয়াবহ বিপদের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশে সাধারণত মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষাকাল থাকে। এই সময় প্রায়ই বৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পানি বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকে এবং এই স্থানগুলোই হলো ডেঙ্গুর অন্যতম উৎপত্তিস্থল। যেকোন বদ্ধ জায়গা ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার বংশবিস্তারের জন্য আদর্শ পরিবেশ। এগুলো লার্ভা অবস্থায় সেখানে সারা বছর অবস্থান করে এবং পরিবেশ অনুকূলে আশামাত্রই এদের বৃদ্ধি হতে থাকে। গবেষণা থেকে দেখা যায়, সংক্রমণের হার মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৪৯.৭৩% এবং বর্ষার শেষের দিকে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসে হচ্ছে ৪৯.২২%। তবে বাংলাদেশে সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবরকেই ধরা হয় ডেঙ্গু সংক্রমণের সিজন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বর্তমানে পুরো পৃথিবীতেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে গ্রীষ্ম মন্ডলীয় দেশগুলোতে এই হার দ্রুত গতিতে বাড়ছে। ডেঙ্গু সাধারণত এডিস ইজিপ্ট নামের মশার মাধ্যমে সংক্রমণ হয়ে থেকে। ডেঙ্গুর সাথে কিছু বিষয় জড়িত যেমন- অনুকূল বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আদ্রতা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭০ সালের পূর্বে মাত্র নয়টি দেশে ডেঙ্গু সীমাবদ্ধ ছিল। তবে বর্তমানে একশটিরও বেশি দেশে অনেকাংশে মহামারি আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আমেরিকা, ওয়েস্টার্ন প্যাসিফিক অঞ্চল সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ঝুঁকি বহন করে। তবে শুধু এশিয়া-ই প্রায় ৭০ ভাগ বেশি সংক্রমণ হয়।

জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত হয়েছে হাজারের অধিক এবং এই সংখ্যাটি ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে জুলাই মাসের প্রথম দশ দিনেই আক্রান্ত প্রায় ৩০০। এদের অধিকাংশই ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে ৭ হাজার ২৫১ জন। তাদের মধ্যে বৃহস্পতিবার ১ হাজার ২৩৮ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। তাদের মধ্যে ১ হাজার ১৪৫ জনই ভর্তি ছিল রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে। চলতি বছর ৩১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আমরা যদি গত তিন বছরের দিকে খেয়াল করি তাহলে দেখব, ২০১৮ সালে আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় দশ হাজারের মতো মানুষ এবং মৃত্যু হয়েছিল ২৬ জনের। কিন্তু ২০১৯ সালে তা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং সেই বছর মারা যায় প্রায় ১৭৯ জন (সরকারি হিসাব মতে)। সেই সময় দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলই সংক্রমিত হয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, দেশে প্রায় এক লক্ষের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল তখন। ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে এক প্রকার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে সেই বছরের ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষ যথেষ্ট সচেতন ছিল। কিন্তু গত বছরের আক্রান্তের সংখ্যা ইতোমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে চলতি বছর। এইভাবে চলতে থাকলে আমাদের সামনে আরো ভয়ংকর সময় আসতে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারী জন সাধারণের উপর সংক্রমণ হার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অনেকেই বুঝতে পারে না সে আক্রান্ত হয়েছে কিনা। কারণ এর লক্ষণগুলো সাধারণ ফ্লু এর মতো এবং কোভিড এর লক্ষণের সাথে অনেকাংশেই মিলে যায়। অনেকেই ফ্লু ভেবে হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে চায় না। এর ফল সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতি হয়। জ্বর যদি সাধারণত ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পৌঁছায় তখন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। এর পাশাপাশি আরো কিছু লক্ষণ দেখা যায়, যেমন- প্রচন্ড মাথাব্যাথা, চোখের পিছনে ব্যাথা, পেশীতে ব্যাথা, বমি, র‌্যাস ইত্যাদি। এসব লক্ষণ দেখলে অতি সত্তর ডাক্তারের পরামর্শ নিতে বলা হয়। তাই এই সময়ে কোভিড এবং ডেঙ্গু নিয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।

যদি কেউ কখনো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় তার প্রথম কাজ হচ্ছে এডিস মশার সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। এতে অসংক্রমিত মশাটি ডেঙ্গু বহন করতে পারবে না। ফলে সংক্রমণ হার কমে যাবে। ডেঙ্গু যাতে মহামারী আকার ধারণ করতে না পারে সেজন্য এডিস মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং ট্রান্সমিশন এর মাধ্যমে যেন ছড়িয়ে দিতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

প্রথমেই মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণকল্পে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ কতে হবে। যেখানে সেখানে বর্জ্য না ফেলে এগুলো সঠিকভাবে ডিসপোস করতে হবে। সেই সাথে খালি পাত্রে পানি যেন জমে না থাকে তা খেয়াল রাখতে হবে। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার বাড়িতে পানি জমে থাকে এমন স্থান পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজনে সব সময় জায়গাটি ঢেকে রাখতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী জমে থাকে এমন পানির পাত্রে মশার লার্ভা ধ্বংসকারী প্রাণী যেমন ব্যাঙ ছাড়া যেতে পারে, পাশাপাশি কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে। অনেকেই এখন শখের বসে বাগান করে থাকে। এতে টবে পানি জমে থাকে এবং এগুলো হতে পারে এডিস মশা লার্ভার অন্যতম আবাসস্থল। যারা বাগান করেন তাদেরকে প্রতিদিনই খেয়াল রাখতে হবে যেন পাত্রে অতিরিক্ত পানি জমে না থাকে।

মশার কামর থেকে বাঁচতে আমাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষাদি গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ঘরের জানালাতে মশা প্রতিরোধক এক ধরনের ঘন নেট বা স্ক্রিন লাগানো যায়, ইন্সেক্ট ধ্বংসকারী উপকরণ কিংবা কয়েল এবং বিভিন্ন ধরনের স্প্রে ব্যবহার করা যায়। আর এগুলো শুধু নিজ বাড়িতেই নয়, কর্মস্থলেও একই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কেননা, আমরা দিনের অধিকাংশ সময় কর্মস্থলেই কাটিয়ে থাকি। বাড়ির আশেপাশে ড্রেইন যেন পরিষ্কার রাখি। দিনের বেলায় ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমানো উচিত।

আমাদের চারপাশের মানুষকে মশাবাহিত রোগসমূহ নিয়ে, এর গুরুত্ব ও ভয়াবহতা নিয়ে সচেতন করতে হবে। এই কাজে সকলের অংশগ্রহণ করাটাই হলো মূল চ্যালেঞ্জ। অনেকেই মশাবাহিত রোগকে গুরুত্ব দিতে চায় না। যখন সমাজের সবাই সচেতন হবে তখনি মশাবাহিত রোগের সংক্রমণ কমে আসবে। পাশাপাশি আমাদের চারপাশে নর্দমা কিংবা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় নিয়মিত লার্ভা ধ্বংসকারী কীটনাশক ছিটিয়ে দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের মাধ্যমে কঠোর মনিটরিং করতে হবে যেন মশার বংশবিস্তার না হয়। ডেঙ্গু মাথাচাড়া দিয়ে উঠার আগেই সন্দেহজনক জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে- সেই স্থানগুলোতে লার্ভার অস্তিত্ব পাওয়া গেলে দ্রুত সেগুলো বিনষ্ট করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতে, কেউ যদি জ্বরে আক্রান্ত হয় সে যেন কোভিডের পাশাপাশি ডেঙ্গু পরীক্ষা করে। কারণ গত কয়েকদিনে দ্রুত গতিতে বেড়েছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। তাছাড়া জনসাধারণ যেন অধিদপ্তরের হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করে। কারণ এই করোনা পরিস্তিতিতে ডেঙ্গু সংক্রমণ বেড়ে গেলে মোকাবিলা করা বেশ কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা।

এই মুহূর্তে প্রতিটি সিটি কর্পোরেশন এলাকা থেকে শুরু করে প্রান্তিক পর্যায়ে ডেঙ্গু মোকাবিলায় কাজ করতে হবে। যেখানে এডিসের লার্ভা পাওয়া যাবে, সেখানেই নির্মূল করতে হবে। সেই সাথে এখন থেকেই জনসচেতনতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রচার মাধ্যমগুলোকে ভূমিকা রাখতে হবে।

ডেঙ্গু দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার আগেই সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। ডেঙ্গু নিরাময়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার, নার্স, ঔষধ এবং অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জামের যেন ঘাটতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, বর্তমানে কোভিডের কারণে চিকিৎসা সেবার বড় একটি অংশ নিযুক্ত আছে। পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগিদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক হাসপাতালের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সেই সাথে ডেঙ্গু টেস্ট কীটের মজুদ বাড়াতে হবে এবং তার প্রচার প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

স্বাস্থ্যসেবায় কোভিড মহামারীর ফলে হাসপাতাল ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। লক্ষনীয় বিষয় হলো, প্রতিদিন হাসপাতালগুলোতে কোভিড রোগীর হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় ডেঙ্গু ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে। বর্তমানে আমরা করোনা মহামারীর সাথে লড়াই করে যাচ্ছি। এই অবস্থায় জনসাধারণ থেকে চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সবাই এক ধরনের মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে অবস্থা কোন দিকে যাবে তা বলা কঠিন। তবে তা যে সুখকর কিছু হবে না তা সহজেই অনুমেয়। আর এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি শুধুমাত্র আমাদের সচেতনার মাধ্যমেই। তাই আমারা যেন বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, নিজে ও অন্যকে সুস্থ রাখি।
লেখক: সহযোগী সম্পাদক, দ্যা এনভায়রনমেন্ট রিভিউ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন