বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের চেষ্টা দীর্ঘদিনের বলে মন্তব্য করেন সংগঠনটির সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। তিনি আরও বলেন, অনেক আইনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নারী কিছু সুফল পাচ্ছে কিন্তু পারিবারিক আইন পরিবর্তন না হওয়ায় তার ব্যক্তিগত অধিকার কোথাও সংরক্ষিত হচ্ছে না।
আজ (সোমবার) বিকাল সাড়ে ৩টায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে ‘সকল নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিতকরণে অভিন্ন পারিবারিক আইন (ইউএফসি) প্রনয়নের লক্ষ্যে’ তরুণ প্রজন্মের সাথে অনলাইনে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি বলেন, নারীকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য সম্পদ-সম্পত্তির সমঅধিকারের কোন বিকল্প নেই। পরিবার একটি প্রতিষ্ঠান, এখানে সকলের সবকিছুতে সমান অধিকার থাকতে হবে। মহিলা পরিষদ অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সম্পত্তি, বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, দত্তক, সন্তানের অভিভাবকত্ব, ভরণভোষণ ইস্যুতে নারীদের সমান অধিকার দেয়ার পক্ষে রষ্ট্রের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে। এখানে রাষ্ট্রেরও দায় আছে। কাঠামোগত বাধার কারণে সরকার এই আইন প্রণয়নে অগ্রসর হতে পারছে না। অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের দাবি প্রণয়নে তিনি সকল সম্প্রদায়কে ও তরুণ প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
সভায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য বাসুদেব ধর, বাংলাদেশ খৃস্টান এসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও এবং মহিলা ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি মধুমিতা বড়ুয়া।
সভায় বক্তারা বলেন, ধর্ম ও পারিবারিক শিক্ষার কারণে নারীরা এখনো পরিবারে সমাজে পুরুষদের আধিপত্যকে সত্য বলে মনে করে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন আবশ্যক হয়ে উঠেছে। সম্পত্তির সমঅধিকারে ধর্মীয় রাজনীতি একটা বৃহৎ ভূমিকা পালন করছে। অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে বিরোধীদের সচেতন করতে, রাজি করতে তরুণসমাজকে এগিয়ে আসতে তারা আহ্বান জানান।
স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু উপস্থিত সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারী-পুরুষের সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। দেশে দেশে মানুষে মানুষে বৈষম্য বিরাজমান আছে। বৈষম্য নিরসনে কয়েকটি ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে এখনো বাধা আছে। মূল মূল বৈষম্য চিহ্নিত করে সংগঠন তা নিরসেনে কাজ করে যাচ্ছে। সংবিধানে নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা হলেও তা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তৃণমূলে বিভিন্ন সময়ে নারীর মর্যাদা নিয়ে কাজ করতে যেয়ে সংগঠন দেখেছে নারীর প্রতি যে সহিংসতা দেখা যায় তার পেছনে বৈষম্য মূলক পারিবারিক আইন একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। এমতাবস্থায় অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন আজ আবশ্যক হয়ে উঠেছে।
সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম বলেন, সকল নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করছে। আইন প্রণয়নের পথে প্রচলিত সামাজিক রীতি-নীতি, সংস্কৃতির যে বাধা আছে তা নিরসনে কাজ করলেও এখনো অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে বাধা আছে। ১৯৯৩ সাল থেকে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ (বিজ্ঞ আইনজীবি, বুদ্ধিজীবী) সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মী সংগঠকদের সাথে মতবিনিময় সভা করে অভিন্ন পারিবারিক আইনের প্রস্তাবনা পূর্ণাঙ্গ করে প্রকাশ করা হয়। এই অভিন্ন পারিবারিক আইনের প্রস্তাবনা বিভিন্ন সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং আইন কমিশনে জমা দিয়ে এই প্রস্তাবনা আইনে পরিণত করার জন্য এ্যডভোকেসি ও লবি করে যাচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীতে সকলের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন আজ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।
সভায় বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য বাসুদেব ধর বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী হিন্দু নারীদের সমঅধিকার দিতে চাইলেও হিন্দু গোষ্ঠীর অনেকে তাতে আগ্রহী নয়। হিন্দু আইন প্রণয়নে প্রয়াত বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য এর ভূমিকা এবং পত্রিকায় তার প্রকাশের পর তার প্রতি আসা বাধার কথা তুলে ধরেন। এসময় তিনি অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে বিরোধীদের সচেতন করতে, রাজি করতে তরুণসমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এবং আন্দোলন অব্যাহত রাখার দাবি জানান। কেননা এই লড়াই বেশ কঠিন।
বাংলাদেশ খৃস্টান এসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও বলেন, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নারীরা পারিবারিক আইন অনুসারে বেশ সুবিধা পেয়ে থাকে। বিভিন্ন পারিবারিক আইনে কিছু বৈষম্য আছে। তবে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণীত হলে সকলের জন্য সহায়ক হবে। সকল ধর্মের গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় থাকবে। আইন প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের সাথে, ধর্মীয় নেতাদের সাথে, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে মতবিনিময় সভা অব্যাহত রাখতে হবে।
মহিলা ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি মধুমিতা বড়ুয়া বলেন, বৌদ্ধদের জন্য কোন আলাদা পারিবারিক আইন নেই। সম্প্রদায়ের অনেকে পারিবারিক আইন প্রণয়নে বিরোধিতা করছে। তৃণমূলের বৌদ্ধ নারীরা অনেক বৈষম্যের শিকার, বঞ্চিত ও লাঞ্চিত যা প্রকাশ পায় না। এমতাবস্থায় অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন হলে সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে সমতা আসবে।
বক্তারা নারীর সম্পত্তির অধিকার ও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ধর্ম ও পারিবারিক শিক্ষার কারণে নারীরা এখনো পরিবারে সমাজে পুরুষদের আধিপত্যকে সত্য বলে মনে করে। নারীর ক্ষমতায়ন করতে হলে কিন্তু জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই বৈষম্য দূর করতে হবে। সম্পত্তির সমঅধিকারে ধর্মীয় রাজনীতি একটা বৃহৎ ভূমিকা পালন করছে। ১০০ বছরের পুরানো এই আইন সংস্কার হওয়া প্রয়োজন।
বক্তারা আরও বলেন, নারীদের সম্পদের অধিকারে বৈষম্য থাকার ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীরা এখনো পিছিয়ে আছে। ভাবা হয় নারীদের কোন বৈষম্য হলেও প্রতিবাদ করার অধিকার থাকবে না। নারী-পুরুষের সমতার বৈষম্য অবশ্যই দূর করতে হবে। এসময় বক্তারা বিভিন্ন আইনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন ব্রিটিশ শাসনামলে ও অভিন্ন পারিবারিক আইন পরিবর্তন এসেছে। হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কার হয়ে বিবাহ আইন, সতীদাহ প্রথা রদ আইন বাল্যবিবাহ বন্ধ আইন হয়েছে। পাকিস্থানি আমলে মুসলিম পারিবারিক আইনে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ৭২ এর সংবিধানের মূললক্ষ্য ছিলো মানুষের সমঅধিকার, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। পারিবারিক আইনগুলো পর্যালোচনা করে একটি সমতাপূর্ণ আইন প্রণয়ন হলে সংবিধানের মূল লক্ষ্য পূরণ হবে।
তারা আরো বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও গভীরভাবে যুক্ত। কিন্তু বৌদ্ধদের জন্য আলাদা পারিবারিক আইন নেই। হিন্দু পারিবারিক আইন দ্বারা বৌদ্ধসমাজের পরিচালিত হলেও বৌদ্ধনারীরা কোন অধিকার পায় না। মারমা নারীরা এখনো সম্পত্তিতে কোনো অধিকার নেই। বান্দরবান জেলার নারীরা সম্পদের চার ভাগের এক ভাগ পায়। আদিবাসী নারীদের অধিকার অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন হলে সকল শ্রেনীর সকল ধর্মের নারীদের অধিকার সংরক্ষিত হবে। অনগ্রসরতা থেকে নারীদের মুক্তি দিতে পারে। এই আইন প্রণয়ন হলেই হবে না, বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে।
উক্ত মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য রাখেন- ব্যারিস্টার এ. কে. এম. রাশেদুল হক, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট; কাজী রোকসানা রুমা, সাংস্কৃতিক কর্মী; অ্যাড. অমিত দাশ গুপ্ত, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও ডেপুটি এ্যাটনী জেনারেল, বাংলাদেশ; অ্যাড. কাকলী মৃধা, হিন্দু বিবাহ রেজিস্টার; ড. জগন্নাথ বড়ুয়া, অধ্যাপক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়; মিনু চিং মারমা, মানবাধিকার কর্মী; অ্যাড. সাবিনা শিপ্রা, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও পুলক বিশ্বাস, তরুণ ব্যবসায়ী এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাবরিনা, নূর-ই তানিয়া, আদিবাসী তরুণী কৃষ্ণা প্রিয়া মূর্মূ, শিক্ষার্থী ধ্রুবজ্যোতি মোহান্ত । এছাড়া সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ ও কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি এবং তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিসহ উপস্থিত ছিলেন ৯৬ জন। সভা সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রোগ্রাম অফিসার (কাউন্সেলিং) সাবিকুন নাহার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন