করোনায় বিপর্যস্ত হয়ে গেছে সিলেটের বিপুল সম্ভবনাময় পর্যটন খাত। ঘুরে দাঁড়ানোর মনোবল ও চেষ্টা সফল হচ্ছে না। পর্যটন খাতের ক্রটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা ও বাজে যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সিলেটের পর্যটন খাত মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগে গড়ে উঠেছে মানসম্পন্ন হোটেল-মোটেল। এই বিশাল বিনিয়োগ এখন ঝুঁকির মধ্যে। নতুন বিনিয়োগ নিয়ে রয়েছে টানাপড়েন। সম্প্রতি পর্যটন স্পট খুলে দিলেও পর্যটক ও দর্শনার্থীর কাক্সিক্ষত সাড়া নেই। কারণ সিলেটে করোনার সংক্রমণ এখনো রয়েছে। মানুষের মনে এখনো করোনা ভীতি বিরাজ করছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরেও ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে বলে মনে করছেন সিলেটের পর্যটন ব্যবসায়ীরা। তারপরও সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলো অল্প সময়ের মধ্যে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের পদভারে মুখর হবে এমন আশায় বুক বেঁধে আছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা ব্যবসায়ীরা।
আকাশে সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিলেটের পাহাড়, ঝর্না, চা বাগান আর হাওরের সৌন্দর্য বরাবরই প্রকৃতিপ্রেমীদের টানে। স্বভাবতই সেই কারণে সিলেটের চার জেলায় পর্যটক সমাগম লেগেই থাকে। গত বছর মার্চে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই বন্ধ করে দেয়া হয় পর্যটন কেন্দ্রগুলো। মাঝখানে কিছুদিন খুলে দেয়া হলেও সংক্রমণ বাড়ায় গত এপ্রিলের শুরুতে আবার পর্যটকদের সমাগমে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। গত ১৯ আগস্ট থেকে পর্যটনকেন্দ্র খুলে দেয়ায় নতুন করে ব্যবসার সম্ভাবনা তৈরির আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। অপরদিকে, পর্যটনকেন্দ্র খুললেও দেশে করোনার সংক্রমণ এখনও কমেনি। এ ছাড়া বেশিরভাগ মানুষ এখনও টিকা নিতে পারেনি। তাই মানুষ ঘুরতে বের হতে ভয় পাচ্ছে। ফলে দেশের অন্যান্য জেলাগুলো থেকে পর্যটকরা সিলেটে ঘুরতে আসছেন না। এর জন্য পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুললেও বোর্ডার পাচ্ছে না সিলেটের হোটেল মোটেলগুলো। অথচ ভরা বর্ষা মৌসুমে প্রকৃতি মুগ্ধতা ছড়ায় সিলেটে। হাওর-বাঁওড়গুলো ধারণ করে অপূর্ব দৃশ্য। সুনামগঞ্চের টাঙ্গুয়ার হাওর, সিলেটের হাকালুকির পানি মুগ্ধতার বিলাশ প্রকৃতি প্রেমীদের বাড়তি আকর্ষণ। কিন্তু এবার সেই হাওরের নেই তেমন পর্যটক বা দর্শনার্থী। দেশের একমাত্র জলারবন রাতারগুল। সেখানে কাক্সিক্ষত পরিমাণ দর্শনার্থী নেই। অলস সময় কাটাচ্ছেন নৌকার মাঝিরা। স্থানীয় বহু লোকের জীবন-জীবিকার উৎস, প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের যাতায়াতের সব রাস্তা যান চলাচলের প্রায় অনুপযুক্ত। এছাড়া সিলেটে রয়েছে- হজরত শাহজালাল, শাহপরানের মাজার, জাফলং, লালা খাল, বিছানাকান্দি , মাধবপুর লেক, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, চা বাগান, কমলার বাগান, আনারস বাগান, মনিপুরী পাড়া, খাসিয়া পুঞ্জি। এ ছাড়া নানান স্থানে রয়েছে পাহাড়ি ছড়া আর ঝর্না। এদিকে, পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্না আর পাথুরে নদীর সৌন্দর্য দেখতে সকল মৌসুমেই পর্যটকরা ভিড় করেন সিলেটের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র বিছনাকান্দিতে। সেখানে পর্যটকদের তেমন আনাগোনা নেই। অন্যদিকে খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। পরিচ্ছনতাকর্মীরা বনে অভ্যন্তরে ঢুকার পথে গজিয়ে ওঠা বন বাদাড় পরিষ্কার করছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। একইভাবে সিলেটের বিমানবন্দর এলাকায় সরকারি মালিকানাধীন পর্যটন মোটেলও পর্যটকদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে কাক্সিক্ষত পরিমাণ দর্শনার্থী বা পর্যটকের উপস্থিতি নেই। তবে, গত ২০ আগস্ট দুপুরে লাউয়াছড়া খুলে দেওয়ার পর থেকে সবুজ এ বন পর্যটকদের পদভারে কিছুটা মুখরিত হয়ে উঠেছে। শুধু লাউয়াছড়াই নয়, পর্যটকরা সেখান থেকে যাচ্ছেন মাধবপুর লেক, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ, চা-বাগানসহ কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে। বিভাগের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট শ্রীমঙ্গল। এখানকার হোটেল-রিসোর্ট ও গেস্ট হাউসগুলোও প্রস্তুত রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত প্রত্যাশিত সাড়া পড়েনি শ্রীমঙ্গলে। শ্রীমঙ্গলের গ্যান্ড সুলতান এন্ড টি রিসোর্ট এর জেনারেল ম্যানেজার আরমান খান বলেন, পর্যটন শিল্পের অবস্থা খুবই খারাপ। এখন পর্যন্ত সেরকম পর্যটক নেই। তবে, সবাইকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসলে স্বরূপে ফিরে আসবে পর্যটন শিল্প।
সিলেট বনবিভাগের টিলাগড়স্থ ইকো পার্কের ইজারাদার আনোয়ার হোসেন বলেন, ঘষে মেজে সব প্রস্তুত করেছি, কিন্তু দর্শনার্থীদের আনাগোনা উল্লেখযোগ্য নেই। সিলেট পর্যটন শিল্প সমবায় সমিতি সভাপতি হুমায়ুন কবির লিটন বলেন, বর্ষা মৌসুমে হাওর-বাঁওড়ের রূপ বৈচিত্র্য উপভোগে মানুষের ঢল নামে। কিন্তু ভাটা পড়েছে। সীমিত আকারে মানুষ আসছে। সিলেটের হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ গোলাম কিবরিয়া লিপন বলেন, অফিসিয়্যাল ট্যুরে হোটেলে বুকিং হচ্ছে। কিন্তু পর্যটকদের সাদা নেই। অর্ধেক বুকিংও হচ্ছে না। এসময় হুড়োহুড়ি থাকে পর্যটকদের বুকিং নিতে। পরিবেশ এখনো অস্থিতিশীল।
সিলেটের হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমাত নুরী জুয়েল বলেন, এখন পর্যন্ত পর্যটকদের তেমন সাড়া পাচ্ছি না। মানুষের আয়-রোজগার কমে গেছে। সরকারি কর্মকর্তা ছাড়া সবাই করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ফলে এখন কেউ ঘুরতে বের হতে চাচ্ছেন না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। তবে অনিবার্য প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা। তিনি বলেন, সিলেটের সব কয়টি পর্যটন কেন্দ্রে যাতায়াতের রাস্তাঘাট আরো প্রশস্ত এবং সুগম হওয়া উচিত। সেই দিকে সরকারের মনোযোগ না থাকলে, পর্যটন শিল্প হুমকির মুখে পড়বে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন