ভারতের উজানের ঢল অব্যাহত রয়েছে। সেই সাথে উজানে ও দেশের অভ্যন্তরে নদ-নদী অববাহিকায় মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ, কোথাও কোথাও অতিবৃষ্টি হচ্ছে। এরফলে দেশের প্রধান নদ-নদীসমূহের অধিকাংশ স্থানে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোথাও কোথাও সাময়িক কমছে পানি। পানির হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে নদীভাঙন তীব্র হচ্ছে। গতকাল বুধবার বিকাল পর্যন্ত পদ্মা, যমুনা, ধলেশ্বরী, আত্রাই, খোয়াই ও গড়াই এই ছয়টি নদ-নদী ৬টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
তবে, সকালে ভাটি-মোহনায় চাঁদপুরে মেঘনা নদীসহ ৬টি নদ-নদী ৭টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার কাছাকাছি রয়েছে। প্রধান নদ-নদী উত্তাল হওয়ার সাথে সাথে এর প্রভাবে শাখা-প্রশাখা, উপনদী, খাল-খাঁড়িগুলোতে বাড়ছে পানি। নদীভাঙন ও বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতির দিকে যাচ্ছে।
জানা যায়, আগামী দুয়েকদিনের মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পানি বাড়তে পারে। এতে করে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, তিস্তা-ধরলা, সুরমা-কুশিয়ারাসহ প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি আরও বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। মূলত উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ও হিমালয় পাদদেশীয় এলাকায় অতি বৃষ্টিপাতের ফলে উজান থেকে ঢল আসা অব্যাহত থাকায় বন্যা এবং সেই সঙ্গে নদীভাঙন পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল হয়ে দক্ষিণে ভাটি ও মোহনায় চাঁদপুর, নোয়াখালী, ল²ীপুর, ভোলা, বরিশাল পর্যন্ত উত্তাল রয়েছে। বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এবং বিস্তীর্ণ এলাকা। করোনা মহামারি সঙ্কটকালে নদীভাঙন কবলিত ও বন্যার্তদের কাজ ও খাবার নেই। অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছে লাখো পানিবন্দী। অনেকের ফল-ফসল, ক্ষেত-খামার, বাগ-বাগিচা, বসতঘর প্লাবিত হয়েছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অনেক এলাকায়।
বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস উল্লেখ করে গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল জানায়, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন ভারতের হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয় প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এরফলে এ সময়ে এসব অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, আপার আত্রাই, আপার করতোয়া, পুনর্ভবা, কুলিখ, ট্যাঙ্গন এবং আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীসমূহের পানির সমতল দ্রæত বৃদ্ধি পেতে পারে।
পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, প্রধান নদ-নদীসমূহের ১০৯টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল ৬৬টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৩৯টিতে হ্রাস ও ৪টি স্থানে অপরিবর্তিত রয়েছে। এরমধ্যে ৬টি নদ-নদী ৬টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত মঙ্গলবার নদ-নদীর ৬৮টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৩৮টিতে হ্রাস, ৩টি স্থানে পানি অপরিবর্তিত এবং এরমধ্যে ৬টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল। সোমবার ৫৮টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৪৭টিতে হ্রাস, ৬টি স্থানে অপরিবর্তিত এবং এরমধ্যে ৬টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হয়। রোববার ৫৮টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৪৫টিতে হ্রাস, ৬টি স্থানে অপরিবর্তিত এবং এরমধ্যে ৭টি স্থানে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হয়।
প্রধান নদ-নদীসমূহের প্রবাহ পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে গতকাল পাউবো জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে, পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীসমূহের পানি স্থিতিশীল রয়েছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় বৃদ্ধি পেতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় টাঙ্গাইল, পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও শরীয়তপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় যমুনা নদ সিরাজগঞ্জ ও মথুরা পয়েন্টে, তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে এবং ধরলা নদী কুড়িগ্রামে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।
প্রধান নদ-নদীর প্রবাহের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে গতকাল বিকাল পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, উত্তর জনপদে যমুনা নদের পানি আরিচা পয়েন্টে বিপদসীমা বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। উত্তর-মধ্যাঞ্চলে আত্রাই নদী বাঘাবাড়ীতে বিপদসীমার ২২ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মধ্যাঞ্চলে ধলেশ^রী নদীর পানি কিছুটা বেড়ে এলাসিন ঘাটে বিপদসীমার ১৯ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মা নদীর পানি কিছুটা হ্রাস পেয়ে গোয়ালন্দে বিপদসীমার ৪৬ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খোয়াই নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে হবিগঞ্জের বাল্লা পয়েন্টে বিপদসীমা বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গড়াই নদী মাগুরা জেলার কামারখালী পয়েন্টে স্থিতিশীল রয়েছে এবং বিপদসীমার ১০ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সাতক্ষীরার কলারোয়ায় বেতনা নদী বিপদসীমার ১৫ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যতম প্রধান অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র নদের সবক’টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার মাত্র ১৪ সে.মি. নিচে রয়েছে। তিস্তা নদীর পানিও ফের বৃদ্ধির দিকে। তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৫ সে.মি. নিচে রয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিলেট বিভাগে এবং বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পার্বত্য অববাহিকায় অনেক নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাসে জানা গেছে, উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, অরুণাচল, সিকিম, হিমালয় পাদদেশীয় ও গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় আরও অন্তত তিনদিন মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ, কোথাও কোথাও অতি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
আতাউর রহমান আজাদ টাঙ্গাইল থেকে জানান, টাঙ্গাইলে ধলেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ও পৌলী নদীর পানি বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। স্থিতিশীল রয়েছে যমুনার নদীর পানি।
এদিকে ধলেশ্বরী, পৌলী ও বংশাই নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বাধ উপচে একের পর এক নিম্নাঞ্চল প্লাবিত যাচ্ছে। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়ছে হাজারো মানুষ।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, যমুনার পানি স্থিতিশীল থাকলেও অভ্যন্তরিণ সকল নদনদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর যে সব এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে সে সব এলাকায় ভাঙন ঠেকাতে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।
শাহীন তারেক মানিকগঞ্জ থেকে জানান, মানিকগঞ্জের আরিচা পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ৮ সেন্টিমিটার কমলেও নদী তীরবর্তী এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। পদ্মা, যমুনা, কালিগঙ্গা, ধলেশ্বরী ও ইছামতির নদীর ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষ ভয়ে দিন কাচ্ছে।প্রতিদিনই বিলীন হয়ে যাচ্ছে শত শত বিঘা জমিও বসতবাড়ী ঘর। অনেকেই নদীতে বাড়ী ঘর হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
গতকাল বুধবার বিকেল ৫ টার দিকে যমুনা নদীর আরিচা পয়েন্টের পানির স্তর পরিমাপক মো. ফারুক হোসেন জানান, এ পয়েন্টে ৯ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটারকে বিপদসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিকেল ৩টা পর্যন্ত এ পয়েন্টে পানি ৯ দশমিক ৪৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
মো. ইব্রাহিম শেখ খাগড়াছড়ি থেকে জানান, দুই দিনের টানা বর্ষণে খাগড়াছড়িতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।। বন্যায় খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা, মানিকছড়ি ও মহালছড়ি উপজেলার বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে পাহাড়ধস। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। বন্যাকবলিত পরিবারগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্যবন্যা দুর্গতদের জন্য খাগড়াছড়ি পৌরসভার পক্ষ থেকে খোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র।
বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেলা শহরের শান্তিনগর, শব্দমিয়া পাড়া, খবং পড়িয়া, গঞ্জপাড়া, মুসলিম পাড়া, মিলনপুর, খাগড়াপুরসহ বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে। সকাল থেকে বৃষ্টি না থাকলেও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। টানা বর্ষণে পানি বেড়ে গিয়ে জেলা সদরের প্রায় ৫শ অধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। তলিয়ে যায় খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম-ঢাকা আঞ্চলিক ও জেলার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো।
জেলার দক্ষিণ গঞ্জপাড়ার বাসিন্দা মোছা. কহিনূর বেগম বলেন, টানা বৃষ্টিতে আমার পুরো ঘরে পানিতে তলিয়ে গেছে। ক্ষতি হয়েছে আসবাবপত্র, খাদ্যসামগ্রী। উত্তর গঞ্জপাড়ার বাসিন্দা মোঃ বাদশাহ বলেন, পানিতে আমার ঘর-বাড়ি সব পানিতে বন্দি। কোনরকম প্রাণে বাঁচলাম। ঘরে থাকা আসবাবপত্র, খাদ্যসামগ্রী-চাল, ডাল সবই এখনো পানিতে তলিয়ে গেছে।
এদিকে বন্যায় প্লাবিত বিষয়ে গোলাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জ্ঞান রঞ্জন ত্রিপুরা মুঠোফোনে জানান, বন্যা পরিস্থিতি বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনসহ পরিদর্শন করেছি। ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য যা যা করা দরকার তা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ি পৌরসভার প্যানেল মেয়র পরিমল দেবনাথ মুঠোফোনে জানান, মাননীয় মেয়র মহোদয়ের নির্দেশক্রমে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় পরিদর্শন করেছি। পরিস্থিতি বিষয়ে তাৎক্ষণিক আমরা পৌরসভায় জরুরি বৈঠকও করে ‘ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ও ব্যবস্থা করে রেখেছি। সাথে ৮হাজার পরিবারের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থাও করেছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন