সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ভয়াবহতায় নদীভাঙন-বন্যা

৯টি নদী ২২ পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে : ১৫ জেলা বন্যা কবলিত

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০০ এএম

দেশের প্রধান নদ-নদীসমূহে একযোগে পানি বেড়ে চলেছে। এর প্রভাবে নদীর শাখা-প্রশাখা, উপনদী, খাল-খাঁড়িগুলোও উত্তাল। দেশের অভ্যন্তরে বৃষ্টি কমেছে। তবে ভারতের উত্তর-পূর্ব, মধ্যাঞ্চল, বিহার, হিমালয় পাদদেশীয় এলাকা ও গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গসহ দেশটির বিভিন্ন অংশে টানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে। অব্যাহত রয়েছে উজানের ঢল। সেই সাথে নিজেদের বন্যামুক্ত রাখতে ভারত পদ্মার উজানে গঙ্গায় ফারাক্কা, তিস্তার উজানে গজলডোবাসহ সবগুলো বাঁধ-ব্যারেজ খুলে পানি ছেড়ে দেয়ায় বেড়ে গেছে উজানের ঢল-বানের তোড়। এরফলে আরো ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে নদীভাঙন ও বন্যা পরিস্থিতি। পদ্মা ও যমুনা নদী একসঙ্গে ফুলে-ফুঁসে উঠেছে। এতে উত্তর, মধ্যাঞ্চল হয়ে দক্ষিণমুখে ভাটি ও মোহনা অঞ্চল বানে ভাসছে। দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে ভাঙন।
সর্বনাশা ঢল-বান, নদীভাঙনে হাজারো পরিবার বসতঘর, ভিটামাটি, ফল-ফসলের জমি-জিরাত, বাগান, ক্ষেত-খামার সবকিছু হারিয়ে পথে বসেছে। প্রমত্তা নদী গ্রাস করছে রাস্তাঘাট, বাঁধ, মসজিদ, স্কুল-মাদরাসা, ক্লিনিক, হাট-বাজার, নৌযানের ঘাট। তলিয়ে গেছে ফললের মাঠ। অসহায় এসব মানুষের জন্য জরুরি সাহায্য-সহায়তার হাত বাড়িয়ে কেউ পাশে নেই। বন্যার্ত ও ভাঙনের শিকার অগণিত মানুষের খাবার নেই, থাকার ঘর নেই। বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসার সঙ্কট প্রকট। কাজকর্মের অভাবে জীবনধারণ দুর্বিষহ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভ‚ঁইয়া জানান, গতকাল শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত ৯টি নদ-নদী ২২টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদ-নদীগুলো হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, ঘাঘট, ধরলা, দুধকুমার, আত্রাই, ধলেশ^রী ও তুরাগ। ভারতের গজলডোবা বাঁধের পানি ছেড়ে দেয়ায় উজানের ঢলে তিস্তা ডালিয়া পয়েন্টে সকালে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হয়। বিকাল নাগাদ কিছুটা নিচে নেমেছে। তাছাড়া রাজধানী ঢাকার আশপাশে এবং অন্যান্য এলাকায় নদ-নদীগুলোতে বাড়ছে পানি। এ পর্যন্ত দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল থেকে মধ্য-দক্ষিণ অবধি ১৫টি জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে। জেলাগুলো হচ্ছে কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পাবনা, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও শরীয়তপুর।
নদ-নদীর প্রবাহ পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। অন্যদিকে যমুনা নদের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রধান নদীসমূহের পানি হ্রাস পাচ্ছে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে।
আজ শনিবার কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও ফরিদপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর অববাহিকায় নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
দেশের নদ-নদী পরিস্থিতি সম্পর্কে পাউবো জানায়, গতকাল বিকাল পর্যন্ত ৯টি নদ-নদী ২২টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বৃহস্পতিবার ৮টি নদ-নদী ১৯টি পয়েন্টে ছিল বিপদসীমার ঊর্ধ্বে। প্রধান নদ-নদীসমূহের ১০৯টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল ৫৪টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৫৪টিতে হ্রাস ও একটি স্থানে অপরিবর্তিত থাকে। বৃহস্পতিবার নদ-নদীর ৬৮টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৪০টি স্থানে হ্রাস ও একটি স্থানে অপরিবর্তিত ছিল। বুধবার ৫০টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি, ৫২টি স্থানে হ্রাস, ৭টি স্থানে অপরিবর্তিত এবং ৭টি নদ-নদী ১৮টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে ছিল।
প্রধান নদ-নদীসমূহের প্রবাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে গতকাল বিকাল পর্যন্ত পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলে দেশের অন্যতম প্রধান অববাহিকা ব্রহ্মপুত্র নদের পানি তিনটি পয়েন্টের সবক’টিতেই বিপদসীমার ঊর্ধ্বে এবং প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। এরমধ্যে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে বিপদসীমার ৫০ ও হাতিয়া পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমা বরাবর প্রবাহিত হচ্ছে।
যমুনা নদের ৯টি পয়েন্টের সবক’টিতেই পানি বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহ অব্যাহত এবং আরো ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। সর্বশেষ অবস্থানে ফুলছড়িতে বিপদসীমার ৫২, সাঘাটায় ৩৪, বাহাদুরাবাদে ৬৩, সারিয়াকান্দিতে ৬৯, কাজীপুরে ও সিরাজগঞ্জে ৬৭, পোড়াবাড়ীতে ৩১, মথুরায় ৩৪ এবং আরিচায় ৩২ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
মধ্য-ভারত, বিহার, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও নেপালে মাঝারি থেকে ভারী টানা বৃষ্টিপাতের কারণে গঙ্গা নদীর উজান থেকে আসছে ঢল। তাছাড়া ভারত ফারাক্কা বাঁধের পানি ছেড়ে দিয়েছে। এরফলে অন্যতম প্রধান অববাহিকা উজানে গঙ্গায় এবং ভাটিতে পদ্মায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পদ্মা নদী চারটি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এরমধ্যে গোয়ালন্দে ৭১, ভাগ্যক‚লে ৯, সুরেশ^রে ১১ ও মাওয়ায় ৪ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে।
উজানে গজলডোবা বাঁধের পানি ছেড়ে দেয়ায় তিস্তা নীলফামারী জেলার ডালিয়া পয়েন্টে গতকাল সকালে বিপদসীমার ৩৫ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অবশ্য বিকাল নাগাদ মাত্র তিন সে.মি. নিচে নেমেছে। চলতি মৌসুমে গতকালসহ বারবার তিস্তায় পানি বৃদ্ধি এবং বিপদসীমা অতিক্রম করে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিশেষত তিস্তার চরাঞ্চলে ফসল, সবজি, ফলমূলের আবাদ ও উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে।
কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর পানি আরো বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৪১ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। দুধকুমার নদী পাটেশ^রী পয়েন্টে বিপদসীমার ১০ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হয়। গাইবান্ধায় ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ১৮ সে.মি. উপরে রয়েছে। উত্তর-মধ্যাঞ্চলে আত্রাই নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে বাঘাবাড়ীতে বিপদসীমার ৬৩ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মধ্যাঞ্চলে ধলেশ^রী নদীর পানি বেড়ে টাঙ্গাইল জেলার এলাসিন ঘাটে বিপদসীমার ৭৫ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানের ঢলের চাপে মধ্যাঞ্চলে রাজধানী ঢাকার আশপাশের নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরে তুরাগ নদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৭ সে.মি. ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে বাড়ছে নদ-নদীগুলোর পানি। পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা কবলিতরা রয়েছে চরম ভোগান্তিতে। ঘরে পানি প্রবেশ করায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে বাঁধে বা আত্মীয়ের বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছে। চারদিকে পানিবন্দি হওয়ায় দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। বয়স্ক ও নারীদের জন্য মলমূত্রত্যাগে সমস্যা প্রকট হয়েছে। চারদিকে পানি থাকায় গবাদিপশুর তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মঞ্জুরুল হক জানান, বন্যার ফলে জেলায় প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর রোপা আমন, শাকসবজি ও বীজতলা তলিয়ে গেছে। অপরদিকে তিস্তা নদীসহ বেশ কয়েকটি নদীতে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন।
চিলমারী (কুড়িগ্রাম) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামের চিলমারীতে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৫০ সেঃ মিঃ উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
নীলফামারী জেলা সংবাদদাতা জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল ভোর থেকে তিস্তা নদীর পানি নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদ দৌলা জানান, উজানের ঢলে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
মানিকগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, মানিকগঞ্জে পদ্মা, যমুনাসহ অভ্যন্তরীন সকল নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চল তলিয়ে প্রায় বিশ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আরিচা পয়েন্টে যমুনা নদীর ৮ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
দৌলতখান (ভোলা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, মেঘনার ভয়াবহ ভাঙনে ভোলার দৌলতখানের হাজিপুর ইউনিয়নের ছয় শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। গত দুইমাসে মেঘনার ভয়াবহ ভাঙনে ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রামের ৪২০টি ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এতে বাস্তুহারা হয়ে পড়ে ইউনিয়নের ছয় শতাধিক পরিবার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন