আশুরা আরবি শব্দ। এর অর্থ দশম দিন। হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমের দশম দিনের গুরুত্ব মুসলমানদের নিকটে অন্যান্য মাস থেকে আলাদা। মহররম মাসের দশ তারিখ আশুরা নামে পরিচিত। ইসলাম ধর্মে ১০ মহররম অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও বরকতময় একটি দিন। পবিত্র মাহে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে এই উম্মতের ওপর এদিনের রোজা ছিল ফরজ। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর এই রোজা নফলে পরিণত হয়। ইসলামে এমন কিছু পর্ব বা দিবস আছে যেগুলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নির্ধারণ করেছেন ইবাদত-বন্দেগী বা নেক আমল করার জন্য। এমনি একটা দিবসের নাম আশুরা। হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররমের দশ তারিখ। মুসলিম উম্মাহর দ্বারে এ দিবসটি কড়া নাড়ে প্রতি বছর।
মুহাররম মাসের গুরুত্ব : ইসলামে চারটি মাসকে বিশেষভাবে নিষিদ্ধ ও পবিত্র ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন নিশ্চই মাসসমূহের সংখ্যা আল্লাহর কাছে বার মাস আল্লাহর কিতাবে, সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্য থেকে চারটি সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। সূতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজদের উপর কোন যুলুম করো না। (সূরা আত-তাওবাহ ৩৬)
মুহাররম মাস সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, এক বৎসরে বার মাস, তন্মধ্যে নিষিদ্ধ হলো চারটি। তিনটি পর্যায়ে ক্রমিক যিলক্বদ, যিলহজ্জ ও মুহাররম। আর অন্যটি হল ‘মুদার’ গোত্রের রজব মাস, যার অবস্থান জুমাদা ও শা’বান মাসের মাঝখানে। ( সহীহ বুখারী) কুরআন এবং হাদীস থেকে প্রতিয়মান হলো মুহাররম একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। কারণ এ মাসের দশ তারিখে (আশুরা) বনী ইসরাঈল তথা মুসলিম জাতির বিজয় হয়েছে।
আশুরা মুসলিম জাতির বিজয়ের দিন : বহুদিন যাবত আল্লাহর নবী মুসা আ. ও তার অনুসারী ঈমানদারদের উপর ফেরাউন ও তার বাহিনীর নির্যাতন ও নিপীড়ন চলছিল। আশুরার এই দিনে নির্যাতন ও নিপীরনের হাত থেকে মুসা আ. ও তার অনুসারীগণ মুক্তি পেয়েছিলেন। সাথে সাথে ফেরাউন ও তার বাহিনীর পরাজয় হয়েছিল। এজন্য এ দিনটি মুসলিম জাতির একটি বিজয়ের দিন। আল্লাহ তায়ালা বলেন “আর বনী ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করিয়ে নিলাম। আর ফেরাউন ও তার সৈন্যবাহিনী ঔদ্ধত্য প্রকাশ ও সীমালঙ্গনকারী হয়ে তাদের পিছু নিল। অবশেষে যখন সে ডুবে যেতে লাগল, তখন বলল, ‘আমি ঈমান এনেছি যে, সে সত্তা ছাড়া কোন ইলাহ নেই, যার প্রতি বনী ইসরাঈল ঈমান এনেছে। আর আমি মুসলমানদের অন্তর্ভূক্ত। এখন অথচ ইতঃপূর্বে তুমি নাফরমানী করেছ, আর তুমি ছিলে ফাসাদকারীদের অন্তর্ভূক্ত। সূতরাং আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নির্দশন হয়ে থাক। আর নিশ্চই অনেক মানুষ আমার নিদর্শনসমূহের ব্যাপারে গাফেল।” ( সূরা ইউনুস:৯০-৯২)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন “আর যখন তোমাদের জন্য আমি সমুদ্রকে বিভক্ত করেছিলাম, অতঃপর তোমাদেরকে নাজাত দিয়েছিলাম এবং ফেরাউনের দলকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম, আর তোমরা দেখছিলে।” (সূরা আল বাকারা: ৫০)
আশুরার দিনটি শুকরিয়া আদায়ের দিন : আশুরার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে এ দিনে মহান আল্লাহ তায়ালা তার নবী মুসা আ. ও তার অনুসারী ঈমানদারদের ফেরাউনের জুলুম থেকে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরাউনকে তার বাহিনীসহ ডুবিয়ে মেরেছেন। হাদীসে এসেছে- সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. যখন মদীনায়আগমন করলেন তিনি আশুরার দিনে ইহুদীদের সওম পালন করতে দেখলেন। যেমন হাদীসে এসেছে “ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ স. মদীনায়এসে দেখলেন যে, ইহুদীরা আশুরার দিনে সওম পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন “এটা কোন দিন যে তোমরা সওম পালন করছ? তারা বললঃ এটা এমন এক মহান দিবস যেদিন আল্লাহ মুসা আ. ও তার সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছিলেন এবং ফেরআউনকে তার দলবলসহ ডুবিয়েমেরেছিলেন। মুসা আ. শুকরিয়া হিসেবে এ দিনে সওম পালন করেছেন। এ কারণে আমরাও সওম পালন করে থাকি। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ স. বললেনঃ “তোমাদের চেয়েআমরা মুসা আ. এর অধিকতর ঘনিষ্ট ও নিকটবর্তী।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ স. সওম পালন করলেন ও অন্যদেরকে সওম পালনের নির্দেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
আর শুকরিয়া আদায়ের অন্যতম মাধ্যম হলো সওম পালন করা। সেজন্য আল্লাহর নবী নূহ আ. এর জাহাজ জুদি পাহাড়ে স্থির হওয়ায় সওম পালন করার মাধ্যমে শুকরিয়া আদায় করেছিলেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, “এ দিনেই (আশুরায়) নূহ আ. এর কিস্তি জুদি পাহাড়ে স্থির হয়েছিল, তাই নূহ আ. শুকরিয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে সে দিন সিয়াম পালন করেছিলেন।” (মুসনাদে আহমদ, ফাতহুল বারী)
শুকরিয়া আদায়ের বিষয়ে কুরআনে কারীমে এসেছে “যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চই আমার আযাব বড়ই কঠিন।” (সূরা ইব্রাহিম:০৭) আল্লাহ তায়ালা হযরত দাউদ আ. এর পরিবারকে শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়ে বলেন “হে দাউদ পরিবার! শুকরিয়া হিসেবে তোমরা নেক আমল করতে থাক। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই শুকরিয়া আদায়কারী রয়েছে।” (সূরা সাবা: ১৩)
আশুরার বিভ্রান্তি সমূহ : মুহাররম মাসকে শোক, মাতম, দুঃখের মাস হিসেবে স্বাগত জানানো। বিভিন্ন আঙ্গিকে হোসাইন রা. এর উদ্দেশ্যে শোক পালন অনুষ্ঠান করা। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে রাসুলুল্লাহ স. বলেছেন, ঐ ব্যক্তি আমাদের অন্তর্ভূক্ত নয় যে গালে চপেটাঘাত কওে, বক্ষদেশে আঘাত কওে তা দীর্ণ-বিদীর্ণ করে এবং জাহেলিয়াতের ডাকের মত আহবান করে। (সহীহ বুখারী)
মুহাররম মাসের প্রথম দিন থেকেই বাড়ি ঘর ঝেড়ে-মুছে, ধুয়ে পরিষ্কার করা এবং খাবার তৈরী করে তাতে সূরা ফাতিহা, বাকারার প্রথম অংশ, সূরা কাফিরুন, ইখলাস, ফালাক ও নাছ পাঠ করা। অুঃপর নবী কারীম স. এর উপর দরূদ পড়ে খাবারের সওয়াব মৃতদের রূহের মাগফিরাতের জন্যে বখশে দেয়া। এ মাসে মহিলাদের সৌন্দর্যচর্চা থেকে বিরত থাকা। এ মাসে জন্ম গ্রহণকারী নবজাতককে দুর্ভাগা মনে করা। মুহাররম ও আশুরার ফজিলত বর্ণনায় দুর্বল কথা, মিথ্যা বাণীর আশ্রয় নেয়া।
আশুরার সওমের গুরুত্ব ও ফজিলত : আশুরার সওম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট খুবই প্রিয়। তাই তিনি এ দিনে সওম পালনের সওয়াব প্রদান করে থাকেন বহুগুণে। যেমন হাদীসে এসেছে, “আবু হুরাইরাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন। রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, রমজানের পর সর্বোত্তম সওম হল আল্লাহ তায়ালার প্রিয় মাস মুহাররম মাসের সওম এবং ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত।” (সহীহ মুসলিম)
এ দিনে সওম পালনের ফজিলত সম্পর্কে হাদীসে এসেছে আবু কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ স. কে আশুরার সওম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হল, তিনি বললেনঃ “ বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গৃহীত হয়।” (সহীহ মুসলিম ও তিরমিজি) অন্য বর্ণনায়এসেছে” আবু কাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, আশুরার দিনের সওমকে আল্লাহ তায়ালা বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।” (সহীহ মুসলিম) হাদীসে আরো এসেছে “যে আশুরার সওম পালন করবে আল্লাহ তার এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।” (মুসনাদুল বাযযার)
ইমাম বায়হাকী রহ. বলেন, “এ হাদীসের ব্যাখ্যা হল- যে সওম পালনকারীর গুনাহ রয়েছে তার গুনাহের কাফফারা হবে আর যার গুনাহ নেই আশুরার সওম তার মর্যাদা বৃদ্ধি করবে।” (ফাযায়েলুল আওকাত: বায়হাকী) মোট কথা আশুরার দিনের সওম হল এক বছরের সওমতুল্য।
রাসূলে কারীম স. এ সওমকে অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দিয়েপালন করতেন। রাসূলুল্লাহ স. যখন মদীনাতে আগমন করলেন তিনি ইহুদীদের সওম পালন করতে দেখলেন তখন তিনি সওম পালন করলেন অন্যদের সওম পালন করতে নির্দেশ দিলেন। এমনকি যারা আশুরার দিনে আহার করেছিলেন তাদের দিনের বাকী সময়টা পানাহার থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিলেন। আর এটা ছিল হিজরতের দ্বিতীয়বছরে। কেননা তিনি হিজরতের প্রথম বছর মুহাররম মাস শেষ হওয়ার একমাস পর অর্থাৎ রবিউল আউয়াল মাসে মদীনাতে আগমন করেছিলেন
“আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন জাহেলী যুগে কুরাইশরা আশুরার সওম পালন করত এবং রাসূলুল্লাহও স. সওম পালন করতেন। যখন তিনি মদীনায়হিজরত করলেন তখন তিনি এ সওম পালন করলেন ও অন্যদের পালন করতে আদেশ দিলেন। যখন রমজান মাসের সওম ফরজ হল তখন তিনি আশুরার সওম সম্পর্কে বললেনঃ “যার ইচ্ছা আশুরার সওম পালন করবে, আর যার ইচ্ছা ছেড়েদিবে।” (সহীহবুখারী ও মুসলিম)
“মহিলা সাহাবী রবী বিনতে মুয়াওয়াজ রা. থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ স. আশুরার দিনে ভোরে মদীনার নিকটবর্তী আনসারদের মহল্লায়খবর পাঠালেন যে, তোমাদের মধ্যে যে সওম শুরু করেছে সে যেন তা পূর্ণ করে। আর যে সওম শুরু না করে খাওয়া-দাওয়া করেছে সে যেন দিনের বাকী সময়টা পানাহার থেকে বিরত থাকে। বর্ণনাকারী বলেন, এ কথা শোনার পর আমরা সওম পালন করলাম এবং আল্লাহর ইচ্ছায়ছোট ছেলে-মেয়েদের দিয়েসওম পালন করালাম। আমরা তাদেরকে মসজিদে নিয়েযেতাম। বাজার থেকে খেলনা কিনে নিতাম। যখন খাবার চাইত তখন হাতে খেলনা তুলে দিতাম, যেন তারা খাবারের কথা ভুলে গিয়েসওম পূর্ণ করতে পারে।” (সহীহ মুসলিম) উপরোক্ত হাদীস দুটি দ্বারা বুঝে আসে আশুরার সওম তখন ওয়াজিব ছিল।
তাই সর্ব-সম্মত কথা হল আশুরার সওম প্রথমে ফরজ ছিল, এখন তা ফরজ নয়, সুন্নাত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন