হাসপাতালটির এয়ারপোর্ট কাউন্টারের কাছাকাছি হতেই ‘সোয়াদিকা’ বলে একজন এগিয়ে এলেন। বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের এই স্বাগত উক্তির পর আমাকে নিজ থেকে আর কিছুর জন্যই অপেক্ষা করতে হয়নি। কাগজপত্র দেখে হাসপাতালে এপয়েন্টমেন্টের স্থান ও তারিখ, থাকার হোটেল, খাবার জায়গা সম্বন্ধে ধারণা দিয়ে দিলেন। তারপর বাহিরে অপেক্ষমান টেক্সি পর্যন্ত এগিয়েও দিয়ে এলেন এখানকারই এক স্টাফ। জানতে পারলাম খুবই অসুস্থ রোগীদের জন্য আরও দ্রুত জরুরি বিভাগে পৌঁছাতে এম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও এখানে আছে। আছে ভিআইপি ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা। আর দিনরাত সবসময়ই হাসপাতালের মত এই সেন্টারটিও বিমান বন্দরে আগত বামরুনগ্রাদের রোগীদের সেবা দিয়ে থাকে।
সকালেই বের হলাম হাসপাতালটি ঘুরে দেখতে। আমাকে সঙ্গ দিতে এসেছেন বাংলাদেশি ফারহিন রহমান, তিনি এই হাসপাতালে বাংলাদেশিদের জন্য আছেন প্রায় ১১ বছর। তাঁর মত আরও কয়েকজন মিলে পরিচালনা করছেন কালচারাল সেন্টারের বাংলাদেশিদের অংশটুকু। প্রায় ১৫০ জনের এক বড় দল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগতদের নিজ নিজ ভাষায় হাসপাতালের সেবা নিতে সাহায্য করছেন। দেশের নাম ছাড়াও নিজ নিজ দেশের পতাকা দিয়ে ডেস্কগুলো সাজান, দূর থেকেই বুঝা যায় এটা কোন দেশিদের সেবা দিচ্ছে। এরা রোগীদের সাথে ডাক্তারের চেম্বার পর্যন্ত যাচ্ছেন, আবার প্রয়োজনে যাচ্ছেন ভর্তি হওয়া কেবিনে। এখানকার রেস্টুরেন্টের খবর, মার্কেটের খবর, মুদ্রাবিনিময়ের ডেস্ক সবই এরা আপনাকে দেখিয়ে দিবে। তাদের পাসের ডেস্কগুলোই হলো এখানকার বিজনেস ডেস্ক। এদের কাজও রোগীদের দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে সাহায্য করা। যেমন কারও ভিসার মেয়াদ শেষ হলে তারা এখান থেকেই তা বাড়িয়ে দেয়ার পুরো কাজটি করে দিচ্ছেন। প্রয়োজনে তারা ভর্তি রোগীর বিছানার পাসে গিয়েও এই সেবা দিয়ে আসেন।
বহিঃর্বিভাগের জন্য বিখ্যাত এই হাসপাতালের ২১ তলা ভবনটি ঘুরে দেখতে আমাদের সাথে আরও যোগ দিলেন ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিংয়ের ম্যানেজার মি. দুয়াংগ্রুদি ওরফে মি. চিং ও ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটিংয়ের এক্সিকিউটিভ মি. সারাওং সিরিবুনপান। প্রথমেই আমরা দেখলাম হাসপাতালের জনপ্রিয় হেল্থ চেকআপের ১১তম ফ্লোর। রেজিস্ট্রেশনের পর এখানকার স্টাফরাই আপনাকে একটার পর একটা কেন্দ্র ঘুরিয়ে শেষকেন্দ্রে আজকের প্রাপ্ত সব রিপোর্টসহ ডাক্তারের মুখোমুখি করবে। আপনার শারীরিক পরীক্ষা, রক্ত, এক্সরে, আল্ট্রাসনো ইত্যাদি রিপোর্টে প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে সরাসরি এবার আলোচনা। কোন অসুবিধা থাকলে আবার কোন ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে তাও তারা বাতলে দিচ্ছেন।
প্রতিটা ফ্লোরেই এভাবেই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন রোগের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ২৭৫টি এক্সামিনেশন স্যুট। কোন ফ্লোরে উইমেনস্ সেন্টার, কোনটায় হার্ট, কোনটায় কিডনি, কোথাও এন্ডোক্রাইন, আবার কোনটায় পাকস্থলি অন্ত্রের ডায়জেস্টিভ সেন্টার। বেশিরভাগ ফেøারই তার নিজ নিজ রোগীদের জন্য একই ফ্লোরে সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা রেখেছে। তাই রোগীকে অন্য কোন ফ্লোরেও সাধারণত যেতে হয় না। মার্কেটিং ম্যানেজার মি. চিং জানালেন, বিভিন্ন ফেøারে এই যে রোগীদের আমরা দেখলাম, এরা এসেছে বিশ্বের প্রায় ১৯০টি দেশ থেকে। কেউ কেউ নিজ থেকেই এসেছে, তবে বেশিরভাগই এসেছে আমাদের ২০টি দেশের ৩৪টি রেফারেল সেন্টারে যোগাযোগ করে। যেমনটি বাংলাদেশের ঢাকাতেও একটা আছে। মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ মি. সিরিবুনপান জানালেন, আপনাদের বাংলাদেশের বেশিরভাগ রোগীই আসে আমাদের উইমেনস্ সেন্টারের সেবা নিতে। প্রেগনেন্সি সংক্রান্ত সেবা, বাচ্চা হয় না অর্থাৎ ইনফার্টিলিটি সমস্যা বা মেয়েলি অন্য কোন সমস্যা নিয়ে। এরপরই সবচেয়ে বেশি রোগী হয় হার্ট সেন্টারে- হার্টের ব্লকের অপারেশন, অনিয়মিত হৃদকম্পনের চিকিৎসা ও অপারেশন, অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ, বাচ্চাদের জন্মগত হার্টের অপারেশন ইত্যাদির জন্য। এরপর আমরা দেখলাম ১২ তলা হাসপাতাল বিল্ডিংও তার প্রতি ফেøার রোগীদের ধরন অনুযায়ী কিভাবে সাজানো। এখানে সামর্থ্য ও রুচি অনুযায়ী ৬ রকমের ৫৮০টি কক্ষ আছে। তারা জানাল, ভর্তির প্রয়োজন নাই এমন রোগীদের জন্য হাসপাতালের ২টি নিজস্ব হোটেল আছে হাসপাতালটির পাশেই। আর হাসপাতালের পাশে অন্যান্য পাঁচ তারকাসহ বিভিন্ন মানের হোটেল ও ইইউটিলিটি ফ্ল্যাটও আছে।
এবার দুপুরের খাবারের জন্য আমরা হেঁটে চলে গেলাম পাসের বাংলা হাউস নামক বাংলাদেশি রেস্তোরাঁয়। আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্যই মি. ফারহিনের সঙ্গে মি. সারাওং সিরিবুনপান ও মি. চিংও জীবনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি খাবার খেতে এলেন এই রেস্তোরাঁয়। বাংলাদেশি মালিক মি. কামরুজ্জামান আমাদের কয়েক রকমের ভর্তা, বিরিয়ানি, সাদা ভাত, রুটি, কয়েক রকমের মাছ দিয়ে আপ্যায়িত করলেন। বাংলাদেশি ছাড়াও অন্যান্য অনেক দেশের পর্যটক ও রোগীদের এখান থেকে খাবার সংগ্রহ করতে দেখলাম। দুপুরের নামাজ পড়তে গিয়ে দেখলাম নামাজের জন্য হাসপালের জায়গায়ই আছে পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা নামাজ ঘর।
দুপুরের খাবারের পর আমরা মিলিত হলাম হাসপাতালটির ইন্টারনেশনাল মেডিকেল ডিরেক্টর মি. এরিক হারলেন ফ্লেশম্যানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, আমাদের নিরন্তর চেস্টা রোগীদের উপকার করা আর আন্তর্জাতিক মানের সেবা দেয়া। আমরা কখনোই বলি না আমরা বিশ্বে শ্রেষ্ঠ। তবে যারা ইউরোপ-আমেরিকায় শ্রেষ্ঠ আমরা তাদের সমকক্ষ এবং সবসময় তা ধরে রাখার জন্য নিজেদের পরিবর্তন করছি। চেষ্টা করছি সেরা ডাক্তার, সেরা টেকনোলজি ব্যবহার করার। ৫৫টি বিভিন্ন স্পেশিয়ালিটির এই কেন্দ্রে ৩০০ সার্বক্ষণিকসহ প্রায় ১৩০০ ডাক্তার রোগীদের সেবা দিচ্ছে। রোবোটিক জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট, অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের রোগীদের জন্য ইপি ল্যাব আমরা কয়েক বছর হলো শুরু করেছি। আমাদের স্পাইন সেন্টারে চালু হয়েছে সর্বাধুনিক এন্ডোস্কোপিক স্পাইন সার্জারি। বলতে পারি রোগীর সংখ্যায় আমরা ওদের চেয়ে এগিয়ে। আমরা প্রতিদিন প্রায় ৫৫০০ রোগীকে আউট প্যাসেন্ট হিসাবেই চিকিৎসা দিচ্ছি। সারা বছরে প্রায় ১৫ লক্ষ রোগীর সেবা দেই, যার প্রায় অর্ধেকই আসে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। প্রতিদিন প্রায় ২০০ এয়ার এবং ল্যান্ড এম্বুলেন্স আমাদের হাসপাতালে আসছে। কোয়ালিটি আর বন্ধুত্বের হাত ওদের মত আমরাও বাড়াই, আর যা আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট তা হল ওদের চেয়ে আমাদের খরচ কম। এই হাসপাতালে থাই রোগীদের জন্য খরচ একটু বেশি আর বিদেশি রোগীদের জন্য খরচ কম, কারণ আমরা সবার জন্য ‘একই সেবা এবং একই খরচ’ পলিসি অনুসরণ করি। বেসরকারি খাতে থাইল্যান্ডে আমরাই প্রথম থাইল্যান্ড হসপিটাল আক্রিডিটেশন পাই ১৯৯৯ সালে, এশিয়ায় সর্বপ্রথম আমেরিকা বেস্ড ‘জেসিআই’ আক্রিডিটেশন আমরা পাই ২০০২ সালে।
বিকালের পর্বে হাসপাতালটির হার্ট সেন্টারের আরিথমিয়া বিশেষজ্ঞ ডা. চিটিকর্ণ কুনাওয়াতের অভিজ্ঞতার কথা শুনি। তারা এখানে হার্টের সকল অপারেশনের পাশাপাশি মেডিকেল চিকিৎসাও দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এখানে আছে কার্ডিয়াক, আইসিইও এম্বুলেন্স, আছে সার্বক্ষণিক ক্যাথ ল্যাবের ব্যবস্থা। অর্থাৎ যে কোন মুহূর্তেই হার্টের রোগী এলে তারা অপারেশন করতে পারবেন। পরিদর্শন করলাম তাদের নতুন টেকনোলজি সমৃদ্ধ ‘ইপি ল্যাব’। এখানে ‘কার্টো’ নামক টেকনোলজি ব্যবহার করে অপ্রয়োজনীয় হৃদস্পন্দন বন্ধ করা হয়, অনিয়মিত স্পন্দনের রোগীরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। ইউরোপসহ যেখানে এখনও এই সুবিধা চালু হয়নি সেখানকার ডাক্তারদের সরাসরি শেখার জন্য ইপি ল্যাবের পাশেই আছে এর কনফারেন্স রুম। এখানে বসে ডাক্তারেরা ল্যাবের ভিতরে যা হচ্ছে তা মনিটরে সরাসরি দেখতে পাচ্ছেন।
বাংলাদেশি রোগীদের বিনামূল্যে এই হাসপাতালের জন্য পরামর্শ ও সেবা দিয়ে সাহায্য করছেন অফিসটির প্রধান কর্মকর্তা মি. কামালুর রহমান, কর্মকর্তা মি. দেলোয়ার হোসেন এবং মিঃ শাহ মোঃ রোকনুজ্জামান। হাসিমুখে সেবা পেতে তাদের পরিচালিত রেফারেল সেন্টারে যোগাযোগ করুন : স্যুট : ৩, লেভেল : ১১, ইউটিসি বিল্ডিং ৮, পান্থপথ, ঢাকা-১২১৫, ফোন-০১৭১৩০২৭৬২৮, ০১৭৫৫৫৫৯৬৩১, ই-মেইল : নঁসৎঁহমৎধফ@ফযধশধ.হবঃ।
ষ ডা. জহুরুল হক
ই-মেইল : ুযংধমধৎ@ুধযড়ড়.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন