বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। রেমিটেন্স ও বেসরকারি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রবণতাসহ কয়েকটি কারণে আগামী অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। ব্যাংকটি বলেছে, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন- যা মোট দেশজ উৎপাদনের ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে নানা জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। এতে দেশে ব্যক্তি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে। যদিও নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে বেশি সময় লাগে না। কিন্তু সমস্যা হলো বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে আবেদনের দিন থেকে ৪০৪ দিন সময় লাগে যা- ভারত, শ্রীলংকা পাকিস্তান, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। আবার জমি বা সম্পদের রেজিষ্ট্রেশন করতে সময় লাগে ২৪৪ দিন, ঠিকাদারের সঙ্গে কোন ঝামেলা হলে তা আইনগতভাবে নিরসন করতে সময় লাগে ১ হাজার ৪৪২ দিন। এসব ক্ষেত্রেও সময় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি বিনিয়োগ কিছুটা বেড়েছে। আর কমেছে বেসরকারি বা ব্যক্তি বিনিয়োগ। এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যবধান দিন দিন বেড়ে চলছে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড.জাহিদ হোসেন বলেছেন, বিনিয়োগ পরিবেশ ব্যবসা বান্ধব হওয়া উচিৎ। যেখানে টাকার গন্ধ থাকবে ব্যবসায়ীরা সেখানে যাবেই। তাদের আদর করে ডাকতে হবে না। এজন্য মূল কাজ হচ্ছে পরিবেশ সৃষ্টি করা।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে সুদের হার কম, এর উপর ব্যাংকগুলোর হাতে রয়েছে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ। অন্যদিকে চাইলেই শিল্পে পাওয়া যাচ্ছে নতুন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ। পাশাপাশি শিল্পে সরকারের নানা প্রণোদনা তো রয়েছেই। এসব কারণে বর্তমান সময়কে নতুন বিনিয়োগের জন্য গত প্রায় এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম সময় বলে উল্লেখ করছেন উদ্যোক্তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মনে করেন দেশে কোন রাজনৈতিক সংকট নেই। অর্থনীতির সব সূচক ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ মনে করেন, দেশে বিনিয়োগের গতি মন্থর একথা ঠিক। দেশে বিনিয়োগের অবস্থা নেই। এক্ষেত্রে রেগুলেটরি বডিগুলোর অদক্ষতা ব্যাংকিং খাতের সমস্যা ও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। যারা নতুন বিনিয়োগ করতে আসছেন তারা দেখছেন দুর্নীতি করে অনেকেই মার্কেট ক্যাপচার করে রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও কৃষি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খালেদও মনে করেন, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে না। এর কারণ অবকাঠামো সমস্যা রয়েছে। বাস্তবত দেখা যাচ্ছে এখন পর্যন্ত প্রবাসী আয়ে মন্দা অব্যাহত রয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টের পর সেপ্টেম্বরেও কমে গেছে প্রবাসী আয়। এমাসে প্রবাসীরা যে পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন তা আগস্ট মাসের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ এবং আগের বছরের একই মাসের চেয়ে প্রায় সাড়ে ২২ শতাংশ কম। প্রবাসী আয় কমার কারণ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদরা বলছেন জনশক্তি রফতানিতে ভাটা, অবৈধ পথে প্রবাসী আয় পাঠানো প্রবণতা বৃদ্ধি, মার্কিন ডলারের বিপরীতে বিভিন্ন মুদ্রার দরপতন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য হ্রাস ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে চলা রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা। এদিকে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টেও সার্বিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে কয়টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে তাহোল, নিরাপত্তা, আর্থিক ও বাণিজ্যিক খাতে ঝুঁকি এবং ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়া। সুশাসনের অভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। বিশ্বব্যাংক মনে করছে সঞ্চয়ের অভাব নয়, বরং বিনিয়োগের অভাবই সমস্যা। সঞ্চয়ের কিছু অর্থ যাচ্ছে রিজার্ভে আর কিছুটা পাচার হচ্ছে। সবমিলে কথা এটাই মনে করা হচ্ছে, অবকাঠামোগত যাকিছু উন্নত হয়েছে বা হতে চলছে তা থেকে প্রকৃত সুফল পেতে হলে যে ধরনের স্থিতিশীলতা প্রয়োজন তা দেশে নেই। এর ফলে আস্থার সংকট যে কাটছে না সেকথা নতুন করে বলার কোন প্রয়োজন নেই।
রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রসঙ্গ নিয়ে যে বারবার আলোচনা করা হচ্ছে এটাই প্রমাণ করে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সংকট রয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক আবহ ছাড়া প্রকৃত বিবেচনাতেই বিনিয়োগকারীরা আস্থা পান না। কারণ, কখন কি হয় সে বোধ থেকেই এক ধরনের মানসিক ঝুঁকিতে তার থাকেনই। এ ঝুঁকি মুক্ত করতে হলে কার্যকর পরিবেশ তৈরি করা দরকার। সকলের সম্মতি ছাড়া এধরনের বাস্তÍবতা তৈরি হয়না, হওয়া সম্ভবও নয়। বিশ্বব্যাংক থেকে যে ধরনের চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে তা কার্যত নতুন কিছু নয়। সব সময়ই বিশ্বব্যাংক মনে করছে স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এবারেও তার বাইরে খুব একটা কিছু বলেনি। এনিয়ে যেসকল অর্থনীতিবিদ আলোচনা করেছেন তারাও একমত যে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো ছাড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা বা ধরে রাখার কোন উপায় নেই। প্রবৃদ্ধির সাথেই সম্পর্ক রয়েছে কর্মবিনিয়োগের। অর্থনীতির অন্যতম প্রাণ সঞ্চারি প্রবাসী খাতের আয় ধরে রাখতে না পারলে অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। এমনিতেই সামাজিকভাবে দেশ এক মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি। মূল্যবোধের অবক্ষয়সহ নানা মারাত্মক সমস্যায় জর্জরিত দেশ। তদুপরি বেসরকারি উদ্যোগ তথা দেশের রেমিট্যান্স পোশাক খাতের আয়সহ অর্থনীতির মূলধারা সচল রাখা না গেলে যে ধরনের সামাজিক বিপর্যয় আসতে পারে তা মোকাবিলা করা কার্যতই কঠিন হয়ে উঠতে পারে। সংশ্লিষ্ট সকলে বিনিয়োগের স্বার্থেই স্থিতিশীলতা অর্জনে আন্তরিক হবেন- এটাই প্রত্যাশিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন