রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

স্বাস্থ্যসেবায় অনৈতিক বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে

প্রকাশের সময় : ৬ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

দেশের সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার নামে অনৈতিক বাণিজ্যের মচ্ছব চলছে। হাসপাতালের আউটডোরে রোগী দেখা থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখা, রোগ নির্ণয় বা ডায়াগনোসিস, ব্লাডব্যাংক এবং সিসিইউ, আইসিইউ’র নামে চলছে অনৈতিক বাণিজ্য। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা খাতের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও অনৈতিক কাজ নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি ও টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও অবস্থার তেমন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছেনা। কোন কোন ক্ষেত্রে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ছলচাতুরির চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতের মানোন্নয়ন ও নজরদারি বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি বিশেষ প্রতিবেদনে চিকিৎসার নামে টেস্ট বাণিজ্যের একটি বিশেষ দিক উঠে এসেছে। একদিকে বড় বড় সরকারী হাসপাতালের পেছনে সরকার বছরে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করছে, অন্যদিকে রোগ নির্ণয় এবং সার্জিক্যাল অপারেশনের জন্য নামসর্বস্ব, মানহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দালালরা সরল সাধারণ রোগীদের সেখানে যেতে বাধ্য করছে। মোটা অংকের মাসোহারা বা কমিশন বাণিজ্যের লোভে একশ্রেণীর ডাক্তারও এই চক্রের সাথে জড়িত আছেন বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। রাজধানীর নামী-দামী হাসপাতালের ডাক্তাররা কিভাবে রোগীদের বার বার নানা ধরনের টেস্টের প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়ে হাজার হাজার টাকা খরচ করাচ্ছেন তার একাধিক কেস স্টাডি উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
গতকালের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারী হাসপাতালে এক ডাক্তার দম্পতির নবজাতক সন্তানকে মৃত ঘোষণা করে প্যাকেট করে ফেলার পর শিশুটিকে জীবিত পাওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। হাসপাতালে এ ধরনের ঘটনার নজির এই প্রথম নয়, মাত্র ১২ দিন আগে ফরিদপুরের একটি হাসপাতালে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। অপ্রয়োজনীয়ভাবে আইসিইউতে রোগী ঢোকানো এবং রোগীর মৃত্যু হলেও রোগীর স্বজনদের না জানিয়ে আইসিইউ’র বিল বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে বেসরকারী কিছু হাসপাতালের বিরুদ্ধে। আর সরকারী হাসপাতালগুলোতে কোটি কোটি টাকায় অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কেনার পরও অনেক যন্ত্রপাতি সাধারণ রোগীদের কোন কাজে আসছেনা। যন্ত্রপাতি কেনার পর মাসের পর মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও প্রয়োজনীয় টেকনিশিয়ানের অভাবে তা রফতানীকারক কোম্পানীর মোড়কজাত অবস্থা থেকে খোলা হয়নি, এমন অভিযোগও নতুন নয়। আবার সুষ্ঠু পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সরকারী যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার পর সেগুলো আর মেরামত বা রিপ্লেসমেন্টের ব্যবস্থা না করার অভিযোগও কম নেই। যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকা অথবা অনিয়ম-অব্যবস্থপানার কারণে সময়মত রিপোর্ট না পাওয়ার আশঙ্কার সুযোগ নিয়েই সরকারী হাসপাতালের ডাক্তাররা রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীদের প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে থাকেন। পুরো বিষয়টিই পরিকল্পিত এবং সিন্ডিকেটেড কারসাজির মধ্য দিয়ে ঘটে থাকে বলে অভিযোগ আছে। এর সাথে একশ্রেণীর ডাক্তারের কমিশন বাণিজ্য এবং মানহীন বেসরকারী ক্লিনিকের উদ্যোক্তা ও দালালদের অনৈতিক যোগসাজশ থাকে।
স্বাস্থ্যসেবা জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার। চিকিৎসা সেবাকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য করতে সরকার প্রতিবছরই শত শত কোটি টাকা বাজেট বাড়াচ্ছে। দেশে অনেক আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এবং চিকিৎসা সুবিধা থাকা সত্ত্বেও দেশের হাজার হাজার রোগী প্রতিবছর প্রতিবেশী দেশসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য। এখাতে বৈদেশিক মুদ্রায় বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। সরকারী হাসপাতালে সব ধরনের সুযোগ সু্িবধা থাকার কথা থাকলেও দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং অনৈতিক কারসাজির সিন্ডিকেটেড বাণিজ্যের জন্য সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের দরিদ্র মানুষ। রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের বড় বড় হাসপাতাল থেকে শুরু করে সারা দেশে জেলা ও উপজেলা হাসপাতালগুলোর বেশীরভাগের অবস্থাই এ রকম। টিআইবি’র এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলিতে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তাদের ১০ হাজার টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। রোগীদের রোগ নির্ণয়ে সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার ও দালালদের কমিশন ভাগাভাগির তথ্যও উঠে এসেছে টিআইবি’র রিপোর্টে। কিছুদিন আগেও চট্টগ্রামের অন্দরকিল্লায় অবস্থিত একটি সরকারী হাসপাতালে ১০-১২ হাজার টাকা দামের প্রতি পিস অটোস্কোপ মেশিন ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা, ১৫ হাজার টাকা মূল্যের ব্লাড ওয়ার্মার মেশিন ৯ লাখ ৩২ হাজার টাকা, সর্বোচ্চ ২ কোটি ৮০ লাখ টাকার এমআরআই মেশিন ৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা কেনার অভিযোগ এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও এর সত্যতা পাওয়া গিয়েছিল। স্বাস্থ্যসবা খাতের মত একটি জরুরী ও জনগুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের প্রতিটি স্তরে এমন দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা পুরো জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। প্রথমে সর্ষের ভেতরের ভূত তাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টদের নজরদারি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসকদের দলবাজি, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়োগ বাণিজ্য, ক্রয় সংক্রান্ত অনিয়ম-অস্বচ্ছতা বন্ধের উদ্যোগ ছাড়া দেশের চিকিৎসা সেবায় জনগণের আস্থা ও সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। দেশের প্রতিটি সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে নির্ভুল ও মানসম্মত সেবা পাওয়া সকলের অধিকার। জীবন বাঁচাতে চিকিৎসার জন্য এসে অপ্রয়োজনীয় রোগ নির্ণয়ের পেছনেই হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতে বাধ্য করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এ ধরনের হয়রানি ও অনৈতিক বাণিজ্য বন্ধ করতে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন