শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌ-রুটে পদ্মা পাড়ি দিতে গিয়ে গত ২৪ দিনে চার বার পদ্মা সেতুতে ফেরির ধাক্কার ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে যেন কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে বহরে ১৭টি ফেরির ১৪টি ফেরিই আনফিট। এসব ফেরির নেই ফিটনেস সনদ, নেই প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি। এ ছাড়া অনেক ফেরির বয়স ৪০ বছর পার হয়ে গেছে। আইন অনুযায়ী, ৪০ বছরের বেশি বয়সি নৌযানের ফিটনেস সনদ দেয়া হয়না। পদ্মা সেতুর পিলারে ফেরি শাহজালালের আঘাতের ঘটনায় গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। কমিটির প্রতিবেদনে ফেরির কারিগরি ত্রুটি ছাড়াও ব্যবস্থাপনায় চরম অনিয়মের বিষয় উঠে এসেছে। এ অবস্থায় পদ্মা সেতুর পিলারে ফেরির ধাক্কা এড়াতে ঘাট স্থানান্তর করতে যাচ্ছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। ঘাট স্থানান্তর না হওয়া পর্যন্ত বাংলাবাজার-শিমুলিয়া রুটে রো রো ফেরি না চালানোরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়েছেন বলে জানান। তিনি বলেন, প্রতিবেদনে ফেরি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) প্রণয়নসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। ওই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে তিনি বলেন, বিআইডব্লিউটিসি দীর্ঘদিন ধরে অবেহেলিত ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৩টি ফেরি এ বহরে যুক্ত করেছেন আরও ফেরি যুক্ত হচ্ছে আমরা পুরোনো ফেরিগুলো ক্রমান্বয়ে সরিয়ে দিচ্ছি।
সর্বশেষ গত ১৩ আগস্ট বাংলাবাজার ঘাট থেকে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া আসার পথে পদ্মা সেতুর ১০ নম্বর পিলারে ধাক্কা দেয় কে-টাইপ ফেরি কাকলি। এ ফেরির ফিটনেস সনদের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৫ সালে। কাকলি ফেরিটি ১৯৭৪ সালে নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা ডকইয়ার্ড এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড-এ তৈরি। এটির বয়স ৪৭ বছর পার হয়েছে। এর আগে ২০০৯ সালে ইঞ্জিন পরিবর্তন করে পুনরায় ফেরিটি চালু করা হয়। কাকলি ফেরির (সাময়িক বরখাস্ত) মাস্টার মো. বাদল হোসেন দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, দুর্ঘটনার সময় মেকানিক্যাল (চেইন সুকান) অকার্যকর ও স্রোতের চেয়ে তার ফেরির ইঞ্জিনের গতি ক্ষমতা কম ছিল। এব্যপারে গত ১১ আগস্ট শিমুলিয়া ঘাটের সহ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) বরাবর, পদ্মার প্রবল স্রোতে (চেইন সুকান) কন্ট্রোলিং কম হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি একটি লিখিত আবেদন করেন। আবেদনে মেকানিক্যাল (চেইন সুকান) অকার্যকর হওয়ার কারণে পদ্মার প্রবল স্রোতে কন্ট্রোলিং কম হচ্ছে যা পদ্মা সেতুর পিলারে ধাক্কা লাগতে পারে বিদায় মাওয়া অঞ্চলে ট্রাফিকে না রেখে অন্যত্র হস্তান্তর করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য উল্লেখ করা হয়। তিনি আরো জানান ‘ফেরি কাকলি’ দুটি ইঞ্জিন ১২০০ আরপিএম করে একেকটি ইঞ্জিন তবে ৮০০ আরপিএম এর বেশি চালানো যেত না। যদি ১হাজার আরপিএম চালানো যেত তাহলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না। সেদিন নদীতে প্রচন্ড বাতাস ছিল ফেরিটি ৮০০ আরপিএম এর বেশি স্পিটে চালানো যায়না যদি ৯শত বা ১ হাজার আরপিএম এ চালানো যেত তাহলে পদ্মার স্রোতের চেয়ে আমার গতি বেশি থাকত তাহলে এই দুর্ঘটনা এড়াতে পারতাম। মো. বাদল হোসেন আরোও বলেন, পদ্মা সেতুর ১১ ও ১২ পিলারের মধ্য চলার কথা ছিল তার কিন্তু নদীর প্রচন্ড স্রোতে ও বাতাসের কারণে ভেসে গিয়ে ১০ নম্বর পিলারে ধাক্কা খান, এতে ফেরির একপাশে ফাটল ধরে তবে পিলারের কোনো ক্ষতি হয়নি।
ফেরি কাকলি ধাক্কার ঘটনায় সেতু প্রকল্পের (মূল সেতু) নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আব্দুল কাদের জানিয়েছেন, কাকলি ফেরির ধাক্কায় পদ্মা সেতুর ১০ নম্বর পিলারের পাইল ক্যাপের কোনো ক্ষতি হয়নি। বার বার সেতুর পিলারে ফেরি ধাক্কার ঘটনার পর পদ্মায় আসেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। ওবায়দুল কাদের বলেন, সর্ষের ভেতরে ভূত আছে কী না তা তদন্ত করে দেখা হবে। খালিদ মাহমুদ বলেছেন, পদ্মা সেতুতে আঘাত লাগলে তা হৃদয়ে লাগে হালকা ধাক্কা হলেও বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়া হচ্ছে না
এর আগে পদ্মা সেতুর ১৭ নম্বর পিলারে গত ২৩ জুলাই আঘাত করে রো রো ফেরি শাহজালাল। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে চলাচলকারী এ ফেরির ফিটনেস সনদের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৪ সালের ২৫ জুলাই। গত সাত বছর ধরে ফিটনেস সনদ ছাড়াই চলছিল এ ফেরিটি। এছাড়াও ফেরিটির ছিল নানা কারিগরি ত্রুটি, ছিল না ভিএইচএফ, ভিটিএসসহ প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি। ফেরিতে ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল স্টিয়ারিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও দুর্ঘটনার সময় মেকানিক্যাল স্টিয়ারিং অকার্যকর ছিল। শুধু ফেরি শাহজালাল নয়, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে বহরে ১৭টি ফেরির ১৪টি ফেরিই আনফিট। বেশির ভাগ ফেরির নেই ফিটনেস সনদ,নেই প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি অনেক ফেরির বয়স ৪০ বছর পার হয়ে গেছে।
বিআইডব্লিউটিসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গত ২০ জুলাই থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত পদ্মা সেতুর পিলারে চারটি ফেরি আঘাত করেছে এতে ওই চারটি ফেরিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে ফেরিগুলো নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে সেগুলোর মধ্যে গত ২০ জুলাই পদ্মা সেতুর পিলারে আঘাত করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফেরি শাহ মখদুম। সেটির ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ায় তা মেরামত করার জন্য ডকে পাঠানো হয়েছে। ১৯৮৫ সালে তৈরি ওই ফেরির বয়স ৩৬ বছর ওই ফেরির ৫০০ হর্সপাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইঞ্জিন ও ঘণ্টায় প্রায় ১৯ কিলোমিটার বেগে চলার কথা থাকলেও সেই ফেরিটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে আঘাত হানে পিলারে।
এর পরের ঘটনা ঘটে গত ২৩ জুলাই পদ্মা সেতুর আরেক পিলারে আঘাত করে রো রো ফেরি শাহজালাল এটি তৈরি করা হয়েছে ১৯৮০ সালে এ ফেরিতে ৫০০ হর্সপাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইঞ্জিন ও ঘণ্টায় প্রায় ১৯ কিলোমিটার গতিতে চলার কথা। গত ৯ আগস্ট পদ্মা সেতুর ১০ নম্বর পিলারে আঘাত দেয়া রো রো ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরেরও একই সমান শক্তিসম্পন্ন দুটি ইঞ্জিন রয়েছে এটির গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ১৯ কিলোমিটার স্রোতের তীব্রতায় এটিও নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পিলারে আঘাত হানে। সর্বশেষ ১৩ আগস্ট পদ্মা সেতুর ১০ নম্বর পিলারে আঘাত করে ফেরি কাকলী। এটি তৈরি করা হয় ১৯৭৪ সালে, এ ফেরিটির বয়স ৪৭ বছর। এটির নেই ফিটনেস সনদ। এ ফেরিতে ৪০০ হর্সপাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইঞ্জিন বিশিষ্ট। এছাড়া ডাম্প ফেরি থোবাল ১৯৩৮ সালে, ফেরি রায়পুরা, রানীক্ষেত ও রানীগঞ্জ ১৯২৫ সালে তৈরি করা হয় এগুলোরও ফিটনেস সনদ নেই।
জানা গেছে, পদ্মা সেতুর পিলারে চারটি ফেরি আঘাত করলেও বেশি আলোচনার জন্ম দেয় গত ২৩ জুলাই রো রো ফেরি শাহজালালের ঘটনা। ওই ঘটনায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) গঠিত কমিটি প্রতিবেদন দেয়। এর পরও উচ্চ পর্যায়ের আরেকটি চার সদস্যের কমিটি গঠন করে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. রফিকুল ইসলাম খানকে প্রধান করে গঠিত এ কমিটি পদ্মা সেতুর প্রকৌশলীসহ আরও তিনজনকে কো-আপ্ট করে পরে সাত সদস্যের কমিটির এ প্রতিবেদন তৈরি করে।
নৌমন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে ওই দিনের ঘটনার কারণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ফেরি ডান দিকে নিতে মাস্টার নির্দেশনা ও সুকানীর তা প্রতিপালনের পার্থক্য, সুকানীর কানে কম শোনা, পানি ও বাতাসের বেগ বেশি থাকায় ফেরিটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পিলারে ধাক্কা দেয়। এতে বলা হয়, নিরাপদ নাবিক সনদ অনুযায়ী ফেরিতে পর্যাপ্ত নাবিক ছিল তবে সুকানী কানে কম শোনেন। তদন্ত কমিটির সামনেও হিয়ারিং এইড পরে বক্তব্য দেন। নৌযানে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৩৫০ হলেও দুর্ঘটনার সময় যাত্রী ছিল ৫০০ থেকে ৬০০ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে ১৭টি ফেরির ১৪টিই ফিটনেসবিহী। বর্তমানে বিআইডব্লিউটিসির বহরে থাকা ৫৩টি ফেরির অনেকগুলোই ৪০ বছরের বেশি পুরাতন। যদিও তদন্ত কমিটির কাছে বিআইডব্লিউটিসি দাবি করেছে, তাদের ফেরিগুলো আন্তর্জাতিক ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির তত্ত্বাবধানে তৈরি হয় বিধায় অনেক মজবুত এবং ৪০ বছর পরও ফেরি পরিচালনা করা আর্থিকভাবে লাভজনক। ফিটনেসবিহীন ফেরির ফিটনেস সনদ না দেওয়ার বিষয়ে প্রস্তাব করতে বলা হয়। দুই সংস্থা বিআইডব্লিউটিসি ও নৌপরিবহণ অধিদপ্তরকে ফেরি পরিচালনায় নানা অব্যবস্থাপনা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেরির মাস্টার নিয়োগে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার বিধান থাকলেও চক্ষু, শ্রবণ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিধান নেই এজন্য নিয়োগ যোগ্যতা সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিটির প্রতিবেদনে ফেরি চলাচলে নিরাপত্তায় স্ট্যান্ডার্ড চার্ট তৈরি, ভিএইচএফ, সিসি ক্যামেরা, জিপিএস, রাডার ও ভিটিএসসহ বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। ফেরি পরিচালনার ক্ষেত্রে এসওপি নেই এটি প্রণয়ন করতে হবে। প্রতিটি ফেরিতে বছরে দুবার সেফটি অডিট চালু করতে হবে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে যাওয়া ও আসার পৃথক রুট নির্ধারণ, ফেরির সামনে ও পেছনে ফেন্ডার লাগানোর সুপারিশ করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন