শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলতে হবে

প্রকাশের সময় : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের শহরগুলোর বাসযোগ্যতার প্রশ্নে প্রথমেই আসে রাজধানী ঢাকার কথা। প্রায় পাঁচশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই শহর এখন বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য, অনিরাপদ শহরগুলোর তালিকায় প্রথম সারিতে রয়েছে। লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক জরিপ ও গবেষণা সংস্থা ইকোনমিক্স ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) পরিচালিত জরিপে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় প্রথম অথবা দ্বিতীয় স্থান লাভ করছে ঢাকা। বিশ্বের ১৪০টি শহরের হেল্থ কেয়ার, শিক্ষাব্যবস্থা, পরিবেশ ও যোগাযোগ অবকাঠামো, জননিরাপত্তা, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সর্বোপরি লাইফস্টাইলের উপর পরিচালিত ইআইইউ জরিপে ২০১৩-১৪ সালে ঢাকা শহর ছিল ১৪০তম। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত নগরী দামেস্কসহ সিরিয়ার নগরীগুলো থেকে লাখ লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে ইউরোপে অভিবাসী হওয়ায় যে সঙ্কট তৈরী হয়েছে তার প্রেক্ষাপটে ইআইউ জরিপে গত বছর দামেস্ক নগরী ১৪০তম বাসযোগ্য শহরের স্থান লাভ করে। ঢাকার স্থান ১৩৯তম। এর মানে এই নয়, যে ঢাকা শহরের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা ও বাসযোগ্যতার উন্নয়ন ঘটেছে। বরং এর উল্টোটাই ঘটেছে। যে সকল কারণে ঢাকা শহরের পরিবেশগত নিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, যানজট নিরসন, আবাসন সমস্যা নিরসনসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তার প্রধান কারণ হচ্ছে ঢাকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা। জাতিসংঘের ২০১৪ সালের এক রিপোর্টে ঢাকাকে বিশ্বের ১১তম জনবহুল শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। একই রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে ঢাকাকে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ঢাকার যানজটমুক্তি ও জনদুর্ভোগ লাঘবে সরকার এবং নবনির্বাচিত মেয়রদের নানাবিধ উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে। ফুটপাথ, অবৈধ স্থাপনা, পার্কিং লট, নদী-সীমানায় অবৈধ দখল উচ্ছেদের অভিযান অবশ্যই ইতিবাচক পদক্ষেপ। প্রতিদিন হাজার হাজার নতুন মুখ দেশের সর্বপ্রান্ত থেকে ঢাকা শহরে আসছে। ঢাকামুখী এসব ভাসমান মানুষের স্রোত বন্ধ করতে না পারলে ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখার অন্যসব উদ্যোগ তেমন কাজে আসবে না। তবে শুধু বস্তি উচ্ছেদ বা ভাসমান মানুষদের ধরপাকড় করলেই এ সমাস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন নয়। কোন সভ্য সমাজে এমনটা কাম্যও নয়। গ্রাম ও জেলাশহরগুলোতে প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান না থাকা, ফসলি জমি কমে যাওয়া, ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার মত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক চাহিদা পূরণ অনিশ্চিত হওয়ায় গ্রামের মানুষ শহরে ভীড় করছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আরবান পপুলেশনের হার বৃদ্ধি বাংলাদেশে সর্বোচ্চ (গড় ৩.৫২ ভাগ)। ঢাকা শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ৬ ভাগের বেশী। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা যে কোন শহরের নাগরিক সুবিধা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। শুধুমাত্র শহরের যানজট নিরসনের উদ্যোগ বা নানাবিধ মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।
গতকাল একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, রাজধানীর কল্যাণপুর বস্তিতে বসবাসরত ২০ হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত স্থানীয় এমপিসহ প্রভাবশালী মহলের পক্ষ থেকে পুলিশি হয়রানির শিকার হচ্ছে। এসব বস্তি থেকে ভূমিহীন পরিবারগুলোকে উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করছিল রাজউক। হাইকোর্টের একটি নির্দেশে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই পুলিশ এবং স্থানীয় প্রভাবশালী মহল প্রকারান্তরে বস্তিবাসিদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে। বস্তির পুরুষ সদস্যদের ধরে নিয়ে যাওয়া, নারীদের লাঞ্ছনা এবং চাল-ডালের মত খাদ্য ও নিত্যপণ্য প্রবেশে বাঁধা দেয়ার অভিযোগ করেছে বস্তিবাসীরা। ঢাকা শহরে এমন শত শত বস্তিতে লাখ লাখ মানুষ মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রায় দুইকোটি মানুষের আবাসন, পয়ঃনিষ্কাশন, যাতায়াদের রাস্তা, গণপরিবহন, গ্যাস-বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধার যোগান নিশ্চিত করার ব্যবস্থা ঢাকা শহরে নেই। এহেন বাস্তবতা সামনে রেখেই বেড়ে চলেছে বস্তি এবং ভাসমান মানুষের সংখ্যা। ক্রমবর্ধমান বস্তি ও ভাসমান মানুষ একদিকে যেমন শহরের আবাসন, যোগাযোগ, গ্যাস-বিদ্যুৎ, পয়ঃনিষ্কাশন এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধার উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে কর্মহীন, দরিদ্র বস্তিবাসীদের অনেকেই মাদকসহ নানাবিধ অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে নাগরিক পরিবেশ বিনষ্ট করছে। বস্তি উচ্ছেদের আগে দীর্ঘদিন বসবাসরত বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের কার্যকর উদ্যোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শহরমুখী জনস্রোত কমিয়ে আনতে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষিসহ গ্রামীণ কর্মসংস্থানের উপর অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। শিল্প-বিনিয়োগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং প্রশাসনিক পরিষেবার বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রামীণ জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের কার্যকর উদ্যোগের পাশাপাশি ঢাকা শহরকে অবৈধ দখল-দূষণ মুক্ত ও বাসযোগ্য করে তোলার দীর্ঘমেয়াদী ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন