আশ্বিন-কার্তিক মাস মানেই ‘মঙ্গা’। ক্ষেতে-খামারে কাজ না থাকায় এই দু’মাস রংপুর অঞ্চলের দিনমজুরসহ স্বল্প আয়ের মানুষ থাকত বেকার। কৃষকের হাতে কাজ না থাকায় ‘মঙ্গা’ দেখা দিত। এজন্য কার্তিক মাসকে এ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হত ‘মরা কার্তিক’।
কচু, কলা সিদ্ধ ইত্যাদি খেয়ে কোন রকমে দিন কাটাত স্বল্প আয়ের মানুষ। কিন্তু এখন সেই ‘মরা কার্তিকের মঙ্গা’ আর নেই। এখন আর কেউ না খেয়ে থাকে না। সরকারের সমন্বিত পরিকল্পনা আর আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া এ অঞ্চলের কৃষি খাতে ব্যাপক বিপ্লব এনে দিয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকরা এখন একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন করছে। প্রযুক্তির বদৌলতে এক ফসলি জমিগুলো হয়েছে তিন থেকে চার ফসলি।
কয়েক বছর আগেও মঙ্গাপীড়িত এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল রংপুর অঞ্চল। বছরের আশ্বিন-কার্তিক মাস এই অভাব বা মঙ্গা ভয়াবহ আকার ধারণ করত। হাতে কাজ না থাকায় কৃষকরা অলস সময় কাটাত। খাদ্যের অভাবে পরিবার-পরিজন কচু সিদ্ধ, কলা সিদ্ধ, চালের কুড়ার ভাত, কাউনের ভাত খেয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাত। কিন্তু এখন আর সেই দৃশ্য নেই। আধুনিক প্রযুক্তি পাল্টে দিয়েছে চিরাচরিত সেই দৃশ্য। এ অঞ্চলের কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়ে অর্থনৈতিক সাফল্য বয়ে এনেছে। পতিত জমি বলতে এখন আর কিছু নেই। নদীর চর থেকে পতিত জমিগুলো ফসলে ফসলে ভরে উঠছে। বারো মাসেই উৎপাদিত হচ্ছে কোন না কোন ফসল।
লাঙল দিয়ে জমি চাষ, মই দেয়া, কৃষাণ দিয়ে ফসল কাটা ও মাড়াইসহ সবকিছুই করত হত কৃষাণ-কৃষাণীদের। গরুর হাল, গরুর গাড়ি, লাঙ্গল, জোয়াল, মই, ঢেকি ইত্যাদি ছিল কৃষকদের প্রধান সম্বল। ধান, গমসহ বিভিন্ন ফসল কাটার জন্য কাস্তেই ছিল প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু এখন আর তা নেই, পাল্টে গেছে সেই দৃশ্যপট। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়ালেও গরুর গাড়ি, লাঙ্গল-জোয়াল, মই চোখে পড়বে না। ঢেকি তো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। এসব যান ও যন্ত্রের পরিবর্তে এখন কমবেশি সব কৃষকের বাড়িতেই দেখা যায় পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, হারভেস্টার, মিনি রাইস মিলসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি। সকল কাজেই এখন কৃষকরা আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষকরা। বীজতলা থেকে থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়েই ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। সব মিলে প্রায় ২০ থেকে ২৫ প্রকারের আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হচ্ছে কৃষিকাজে।
জমি চাষ ও নিড়ানি থেকে শুরু করে জমিতে সার, কীটনাশক দেয়া, ধান কাটা-মাড়াই ও শুকানোর কাজসহ চাল তৈরির প্রক্রিয়ায় এখন যোগ হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি। সেচ কাজে ব্যবহার হচ্ছে শ্যালো মেশিন কিংবা বৈদ্যুতিক পাম্প। বীজ বপনের কাজে ব্যবহার হচ্ছে ড্রাম সিডার, মাড়াইয়ের কাজে পাওয়ার থ্রেসার (পায়ে চালিত মাড়াই যন্ত্র), গ্রেডিং মেশিন। এর ফলে চাষাবাদের খরচ, সময় ও শ্রমিক কম লাগছে, কিন্তু উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে গেছে। কম্বাইন হারভেস্টার নামে আরেকটি যন্ত্র আরো সহজ করে দিয়েছে কৃষকের কাজকে। এই যন্ত্রটি রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে কৃষকের হাতে পৌঁছে গেছে। বদরগঞ্জ উপজেলার ষাটোর্ধ কৃষক আজিজার জানিয়েছেন, আধুনিক যন্ত্রপাতি কৃষিকাজের গতি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। আগে ৬০ শতক জমির ধান কাটা, মাড়াই করতে খরচ হতো তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। এখন কম্বাইন হারভেস্টার মেশিনের মাধ্যমে খরচ হচ্ছে মাত্র ৬শ’ থেকে ৭শ’ টাকা। আগে ধান বেচতে গেলে গরুর গাড়ি নিয়ে ফজরের নামজ পড়ে হাটে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিতাম, ধান বেচে ফিরে আসতাম এশার নামাজের পর। সারাদিন যেত। আর এখন পিকাপ কিংবা পাওয়ার টিলারে করে ধান নিয়ে আধাঘণ্টা থেকে ১ ঘণ্টার মধ্যে হাটে গিয়ে বিক্রি করে বাড়িতে এসে অন্যান্য কাজ সেরে যোহরের নামাজ পড়া যায়। পদাগঞ্জ এলাকার প্রবীণ কৃষক একরামুল জানান, ১০/১৫ বছর আগেও অনেক পিছিয়ে ছিলাম আমরা। গরুর হালের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় ছিল না। বীজ বপন, চারা রোপণ এবং ফসল কেটে ঘরে তুলে মাড়াই পর্যন্ত বেশ সংকটে পড়তে হত। প্রতিটি মওসুমে কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যেত। দ্বিগুণ মজুরি দিয়েও কৃষি শ্রমিক পাওয়া যেত না। এতে অনেক সময় বিলম্বে বীজ বপন, চারা রোপণের কারণে ফলন কম হত। পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পেত। এখন আধুনিক যন্ত্রপাতি কৃষকের কাজ সহজ করে দিয়েছে এবং খুব কম সময়ের মধ্যে হচ্ছে।
কৃষিবিদদের মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারিগর হলো কৃষক। কৃষি খাতে সমৃদ্ধি মানে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশেও কৃষিতে লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে কৃষক/কৃষানীর দিন শুরু হত কাক ডাকা ভোরে আর শেষ হতো সন্ধ্যাবেলার পাখির কিচিরমিচির শব্দে। মাড়াই করা ধান গভীর রাত পর্যন্ত সিদ্ধ করে পরদিন রোদে শুকিয়ে ঢেকির মাধ্যমে চাল তৈরি করত। কৃষকরা জমিতে সেচ কাঠের তৈরি কুয়ো থেকে পানি উঠিয়ে। হাতে ছিটিয়ে ব্যবহার করা হতো সার ও কীটনাশক। আগাছা পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহার করা হতো নিড়ানি। এক একর জমির ফসল শ্রমিক দিয়ে কর্তন ও মাড়াই কাজে ব্যয় হত প্রায় ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। অথচ মিনি কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করে একই কাজে ব্যয় হয় তিন থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এক একর জমিতে শ্রমিক দিয়ে চারা লাগাতে খরচ হত প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। অথচ আধুনিক প্রযুক্তির রাইস ট্রান্সপ্লান্ট দিয়ে চারা লাগাতে খরচ হয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা। সময়ও লাগে চার ভাগের এক ভাগ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, প্রযুক্তির বহুমুখি সুবিধার কারণে কৃষকরা দিন দিন আধুনিক কৃষিযন্ত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। আধুনিক কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের ফলে কৃষকরা কম খরচে স্বল্প সময়ে ফসল উৎপাদন করতে পারছে। একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন করতে পারছে। এখন প্রয়োজন শুধু আধুনিক প্রযুক্তির এসব যন্ত্রপাতি সহজিকরণ করা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন