৯ সেপ্টেম্বর, পাকুয়াখালী ট্রাজেডি দিবস। ১৯৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনী রাঙ্গামাটি জেলার পাকুয়াখালীতে নিরীহ এবং নিরস্ত্র বাঙালি কাঠুরিয়াদের উপর নির্মম হত্যাকান্ড চালিয়ে তাদের বিভৎস মানসিকতার এক জঘন্যতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। স্বাধীনতার পর পরই জেএসএস তথা শান্তিবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পার্বত্যাঞ্চলের সহজ-সরল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলোকে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়ে শুরু করে সশস্ত্র তৎপরতা। প্রথম থেকেই তারা নিরাপত্তা বাহিনী এবং নিরীহ বাঙালিদের বিরুদ্ধে চালাতে থাকে একের পর এক আক্রমণ। যে কোন নিরীহ এবং নিরস্ত্র মানুষের উপর সশস্ত্র আক্রমণ করাই যেখানে মানবতা বিরোধী চরম অপরাধ, সেখানে শান্তিাবাহিনীর সন্ত্রাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরস্ত্র-নিরীহ বাঙালিদের উপর হাজার হাজার সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করেছে। কথিত আছে, শান্তিবাহিনী হত্যা করেছে ৩০ হাজারেরও বেশি বাঙালি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে। এর মধ্যে কিছু কিছু গণহত্যার ঘটনা আছে যেগুলোকে কোনভাবেই কোনো মানুষের কর্ম বলে বিশ্বাস করা যায় না। বিশেষ করে, ২৯ এপ্রিল ১৯৮৪ খাগড়াছড়ি মাটিরাঙ্গা গণহত্যা, ৩০ মে ১৯৮৪ দিবাগত রাতে সংঘটিত রাঙ্গামাটি জেলার ভূষণছড়া গণহত্যা এবং ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ রাঙ্গামাটির পাকুয়াখালী গণহত্যা অন্যতম। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল আছেন, তারা পাকুয়াখালী গণহত্যাকে শান্তিবাহিনীর নৃশংসতম গণহত্যা বলে স্বীকার করেন। কেননা, সেদিন শান্তিবাহিনী মিটিং করার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ডেকে নিয়ে ৩৫ জন নিরীহ বাঙালি কাঠুরিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। অবাক করার বিষয় হচ্ছে যে, শান্তিবাহিনী সেদিন এতগুলো মানুষকে হত্যা করতে একটি বুলেটও ব্যবহার করেনি। হাত-পা বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, দা-দিয়ে কুপিয়ে এবং বন্দুকের বেয়নেট ও অন্যান্য দেশি অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে হত্যা করেছিল এই অসহায় মানুষগুলোকে। প্রতিটি লাশকেই বিকৃত করে সেদিন চরম অমানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তারা।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। সে সময় সবাই আশা করছিল যে, এবার হয়তো পার্বত্যাঞ্চলের সমস্যাটি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা সম্ভব হবে। কেননা, এরশাদ সরকারের আমলেই শান্তিবাহিনীর সাথে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল। এরপর বিএনপির সরকার (১৯৯১-৯৬) আমলে এই আলোচনা আরো বিস্তৃতভাবে অনুষ্ঠিত হয়। একে একে অনুষ্ঠিত হয় ১৩টি বৈঠক। কিন্তু শান্তিবাহিনীর নানা অযৌক্তিক দাবির কারণেই শেষ পর্যন্ত চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়ে ওঠেনি। এমতাবস্থায়, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে ধারণা জম্মেছিল যে, এবার হয়তো বিষয়টি নিষ্পত্তির দিকে যাবে। কেননা শান্তিবাহিনীর আশ্রয়দাতা প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ভালো।
অতএব, ভারতও চাইবে না শান্তিবাহিনী তার চিরাচরিত অপকর্ম দ্বারা আওয়ামী লীগ সরকারকে বিব্রত করুক। এমন আশা কিংবা আশঙ্কার মধ্যেই শান্তিবাহিনী ৯ সেপ্টম্বর ১৯৯৬ পাকুয়াখালী ট্রাজেডির জন্ম দেয়। এসময় পুরো পার্বত্যাঞ্চলই ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত। শান্তিবাহিনী এসময় স্বঘোষিত অস্ত্র বিরতি দিয়ে, চাঁদা আদায় এবং অস্ত্র সংগ্রহের প্রতিই বেশি মনোযোগী ছিল। সেই সাথে সরকারের সাথে নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে দেন-দরবার করার জন্যও সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। অন্যদিকে নিজেদের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছিল সর্বাত্মকভাবে। তাই, তখন পার্বত্যাঞ্চলের নিরীহ অসহায় পাহাড়ি-বাঙালিরা শান্তিবাহিনীকে নিয়মিত চাঁদা দিয়ে পাহাড় থেকে বাঁশ-কাঠসহ অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করছিল। রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলার সীমান্তবর্তী বাঘাইছড়ির পাকুয়াখালীতেও একই অবস্থা চলছিল। এখানে প্রতিদিন শত শত পাহাড়ি এবং বাঙালি কাঠুরিয়া শান্তিবাহিনীকে চাঁদা দিয়ে বাঁশ এবং গাছ কাটতে যেত পাহাড়ে।
চাঁদা আদায়সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য মাঝে-মধ্যে পাহাড়ে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঠুরিয়াদের বৈঠক হতো। এক পর্যায়ে ৯ সেপ্টেম্বর ’৯৬ একটি বৈঠক ডাকা হয়। এই বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য কাঠ ব্যবসায়ীদেরও নেয়ার জন্য শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়। শান্তিবাহিনীর কালেক্টর লংগদু থানার মাইনীমুখ বাজারে এসে ব্যবসায়ীদের চিঠির মাধ্যমে বৈঠকে অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানায়। কোনো বৈঠকে ব্যবসায়ীদের এভাবে গুরুত্ব দিয়ে ডাকা হয়নি। ফলে ৯ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে ব্যবসায়ীদের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ায় ব্যবসায়ীরা বিষয়টি এড়িয়ে যায়। কিন্তু কাঠুরিয়ারা প্রতিদিনের মতো সেইদিন সকাল বেলা স্বাভাবিকভাবেই পাহাড়ে প্রবেশ করতে শুরু করে। তখন শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদেরকে জানানো হয়, বড়বাবু আজ সবার সঙ্গে মিটিং করবেন। তাই আগে মিটিংয়ে যেতে হবে। এর পর যে যার কাজে যাবে। একথা বলেই এক সাথে চার-পাঁচজন বাঙালি কাঠুরিয়াকে কিছুদূর নিয়ে গিয়ে হাত-পা বেঁধে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেদিনকার বাঁধা অবস্থা থেকে পালিয়ে আসা এক মাত্র ব্যক্তি মোহাম্মদ ইউনুছ মিয়া। এই ইউনুছ মিয়ার দেখানো পথ ধরেই পরে ১১ সেপ্টম্বর খুঁজে বের করা হয় ২৮ জনের ক্ষত-বিক্ষত, বিকৃত লাশ। কারো হাত নেই, কারো চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, কারো কেটে নেয়া হয়েছে কান কিংবা পুরুষাঙ্গ। কাউকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে থেতলে দেয়া হয়েছে মাথা। আবার কাউকে জবাই করা হয়েছে অমানবিকভাবে। অপর ৭ হতভাগ্যের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমন নির্মম দৃশ্য দেখে সেদিন পার্বত্যাঞ্চলের আকাশ-বাতাস স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। শোকে ভারি হয়ে ওঠেছিল সমস্ত পরিবেশ। পরে উদ্ধার করা লাশগুলি এনে লংগদু উপজেলা মাঠ সংলগ্ন খোলা যায়গায় দাফন করা হয়।
সেদিন নিহত ৩৫ কাঠুরিয়ার স্বজনদের আহাজারী আর উত্তাল পার্বত্য পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখার জন্য তৎকালীন সরকারের ৪ জন প্রভাবশালী মন্ত্রী লংগদু সফর করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম, শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহম্মদ, পানিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এবং শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী এম. এ. মান্নান। তাঁরা লংগদু গিয়ে মানুষের বুক ফাটা কান্না আর আহাজারী দেখে হত্যকারীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করার। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সন্তাদের লেখা-পড়ার দায়িত্ব নেয়ার প্রতিশ্রুতিও তারা দিয়েছিলন। তারা লংগদু থেকে ফিরে আসার পর তৎকালীন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সুলতান মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটি ৩১ অক্টোবর ’৯৬ ইং বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।
তবে ১ নভেম্বর ১৯৯৬ দৈনিক জনকণ্ঠের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, উক্ত প্রতিবেদনে শান্তিবাহিনীকেই পাকুয়াখালী ট্রাজেডির জন্য দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার ২৫ বছর পরেও শান্তিবাহিনীর সন্ত্রসাীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কোনো প্রক্রিয়া শুরু করা হয়নি। পুনর্বাসন করা হয়নি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে। ক্ষতিগ্রস্তদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারেও কোনো দায়িত্ব নেয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। তাই আজ তারা শিক্ষা-দীক্ষাহীনভাবে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছে।
১৯৯৭ সালে শান্তিবাহিনী সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে অস্ত্র জমা দিলেও তারা তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে বলে বিশ্বাস করা যায় না, কেননা পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাস এবং চাঁদাবাজি রয়ে গেছে আগের মতোই। বরং, চুক্তির পূর্বে যেখানে একটি সংগঠন চাঁদাবাজি করতো এখন তারা চারটি ভাগে বিভক্ত হয়ে সেটা করছে। ফলে পাহাড়ের মানুষের জীবন অতিষ্ট করে তুলছে তাদের চাঁদাবাজি। পাহাড়ে সংগঠিত বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দেখে বুঝা যায় ধীরে ধীরে তারা অস্ত্রের মজুদ বাড়িয়ে আরও শক্তিশালী হচ্ছে। মাঝে-মধেই জেএসএস নেতাদের আবারো জঙ্গলে গিয়ে বিদ্রোহী হয়ে ওঠার হুমকি থেকেও এটা প্রমাণিত। তাছাড়া কোনো অপকর্ম করে বিচারের সম্মুখীন হবার আশঙ্কা যদি না থাকে তাহলে অপরাধীরা তো তাদের অপকর্মে উৎসাহ পাবেই। তাই মানবাধিকার এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই পাকুয়াখালী গণহত্যাসহ সকল হত্যাকান্ডের তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা প্রয়োজন।
লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক ও প্রান্ধিক
sayedibnrahmat@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন