শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভারত থেকে ডিজেল আমদানি পুনর্বিবেচনা করুন

প্রকাশের সময় : ৭ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশ ভারত থেকে ডিজেল আমদানি করছে। আপাতত ১০ লাখ টন ডিজেল আমদানি করা হবে। কিন্তু অন্যান্য দেশ যথা আরব আমিরাত থেকে যে দামে ডিজেল আমদানি করা হয়, ভারত থেকে আমদানিকৃত ডিজেলের দাম তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশী হবে। গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন প্রতিযোগিতামূূলক মূল্যে আমিরাত থেকে ৬ লাখ ৬০ হাজার টন ডিজেল আমদানি করে। এর মূল্য পড়ে টন প্রতি ২০.০৩ মার্কিন ডলার। পরিবহন খরচ ও বিমা খরচ এই ২০.০৩ মার্কিন ডলারের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। অথচ ভারত থেকে যে ডিজেল আমদানি করা হবে তার মূল্য পড়বে টন প্রতি ৪৬ মার্কিন ডলার। এই আমদানি চূড়ান্ত করার জন্য বাংলাদেশের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বর্তমানে ১৮ সদস্যের একটি টিম নিয়ে নয়া দিল্লীতে অবস্থান করছেন। যে বিষয়টি আরো বিস্ময়ের সেটি হলো, এটি হতে যাচ্ছে একটি দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তি। অবশ্য এই দীর্ঘ মেয়াদ বলতে কত বছর বোঝাচ্ছে সে সম্পর্কে এখনো স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। বাংলাদেশের একটি ইংরেজি দৈনিকের মতে, তুলনামূলক উচ্চতর মূল্যে ডিজেল আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দীর্ঘ মেয়াদে ভারতের কাছে বাঁধা পড়লো। বাংলাদেশের প্রতিমন্ত্রী নয়া দিল্লীতে জানান যে, টন প্রতি যে ৪৬ ডলার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে তার মধ্যে পরিবহন এবং বিমার খরচও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ভারত পেট্রোলিয়ামের সহযোগী নুমালিগড় তেল পরিশোধন কোম্পানী বছরে বাংলাদেশের নিকট ১০ লাখ টন জ্বালানি অর্থাৎ ডিজেল রফতানি করবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই পরিশোধন কোম্পানীটি আসামের গোয়ালঘাটে অবস্থিত। একটি পাইপ লাইনের মাধ্যমে এই ডিজেল সরবরাহ করা হবে। পাইপ লাইনটির দৈর্ঘ্য হবে ১৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ স্থাপন করবে ১২৫ কিলোমিটার। পাইপ লাইন স্থাপন করতে খরচ হবে ৬০০ কোটি টাকা। এই খরচ কে বহন করবে সেটি এখনো পরিষ্কার করা না হলেও ধারণা করা হচ্ছে যে, এই ব্যয় নির্বাহ করবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ডিজেলের চাহিদা বছরে ৩৫ লাখ টন। এর মধ্যে ৩০ লাখ টনই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। অবশিষ্ট ৫ লাখ টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করে বাংলাদেশেই সেটি শোধন করা হয়। দৈনিকটির রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে যে, গত ১৯ মার্চ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন এই নুমালিগড় পরিশোধনাগার থেকে ২২০০ টন ডিজেল আমদানি করে। প্রতিটন ডিজেল আমদানিতে খরচ পড়ে ৫৯ মার্কিন ডলারের চেয়ে বেশী। রেলগাড়ির মাধ্যমে এই ডিজেল বাংলাদেশে পরিবাহিত হয়। এটি আমিরাত থেকে আমদানি করা ডিজেলের প্রতিটন মূল্যের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ বেশী। কেন এতো উচ্চ মূল্যে ভারতের কাছ থেকে এই ডিজেল ক্রয় করা হলো সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বিপুল অবদানের কথা স্মরণে রেখে পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে এই উচ্চ মূল্যে ডিজেল আমদানি করা হয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সাহায্য করেছিলো বলেই এতো অধিক মূল্যে অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশী মূল্যে ভারত থেকে ডিজেল আমদানি করতে হবে এবং সে জন্য অনির্দিষ্টকালের এক দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তিতে আবদ্ধ হবে কেন, সেটি মানুষের বোধগম্য হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের পর ৪৫ বছর অতিক্রান্ত হতে চললো, আজও কি ভারতের ঋণ শোধ হয়নি? ৬০ বছর ধরে ভারত বাংলাদেশের নিকট থেকে ট্রানজিট চেয়ে আসছিলো, কিন্তু পায়নি। এখন তাকে সেই ট্রানজিট দেওয়া হয়েছে, সেটিও আবার নামকা ওয়াস্তে মূল্যে। তারপরেও কি ভারতের ঋণ পরিশোধ হয়নি? ভারতের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা ছিলো উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭ রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় ৫০ বছর ধরে চলে আসা এই ৭ রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ভারত দমন করতে সমর্থ হয়েছে। তারপরেও কি ভারতের ঋণ পরিশোধ হয়নি? জ্বালানি ও বিদ্যুৎ এখন যে কোনো দেশের অর্থনীতির প্রাণ। জ্বালানি এবং বিদ্যুৎকে সভ্যতার ও প্রাণ বলা হয়। সেই জ্বালানি নিয়ে যেসব নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে সেগুলো নিয়ে ইতোমধ্যেই একাধিক দায়িত্বশীল মহলে কথা উঠেছে।
রূপপুরে রাশিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে। গতকাল বৃহস্পতিবার একটি বাংলা দৈনিকের খবরে প্রকাশ, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তির পাশাপাশি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনার জন্যও সরকারকে রাশিয়ার সঙ্গে আলাদা পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ (ওএন্ডএম) চুক্তি করতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রর জন্য জ্বালানি (ইউরেনিয়াম) সরবরাহ করবে রাশিয়া। এছাড়া প্রকল্পের প্রযুক্তি ও অন্যান্য কারিগরি বিষয় বুঝে নেয়ার মতো জনবলের অভাব থাকায়, এক্ষেত্রেও রাশিয়ার প্রতি আস্থা না রেখে উপায় নাই। এছাড়া বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পাইপ লাইন বসিয়ে মিয়ানমার থেকে ভারতে গ্যাস নেয়া এবং ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে গ্যাস আমদানির বিষয়েও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। বাংলা দৈনিকটির খবরে আরো বলা হয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আয়ুষ্কাল জুড়ে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে বাংলাদেশের। এসব খবর থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে, জ্বালানি এবং বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দিনের পর দিন এক বা একাধিক রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এটি একদিকে যেমন অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, অন্যদিকে তেমনি জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্যও অনুকূল নয়। ভারত থেকে ডিজেল আমদানির চুক্তি ইতোমধ্যেই সম্পাদিত হয়েছে কি না সেটি এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। যদি সম্পাদিত না হয়ে থাকে তাহলে এই চুক্তি সম্পাদন করা বাঞ্ছনীয় হবে না। আর যদি ইতোমধ্যে সম্পাদিত হয়েও থাকে তাহলেও সেটি অনতিবিলম্বে পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন