গত মাসে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর ১৫ আগস্ট তালেবান তালেবানরা প্রতিবেশী আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রথমবারের মতো সাক্ষাৎকার দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ইমরান খান। বুধবার ইসলামাবাদে ইমরান খানের ব্যক্তিগত বাসভবন বাণীগালা থেকে সিএনএনকে দেয়া তার সেই সাক্ষাতকারের উল্লেখযোগ্য অংশ দু’পর্বে প্রকাশ করা হ’ল।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, ‘আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে তালেবানদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া এবং নারীদের অধিকার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারের মতো বিষয়ে তাদের উৎসাহিত করা।’ তিনি বলেন, ‘মানবাধিকার ইস্যুতে তালেবানদের সময় দেয়া উচিত। এবং সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া সেখানে বিশৃঙ্খল এক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।’ ইমরান খান বলেন, ‘তালেবানরা পুরো আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। তারা যদি এখন সবার অংশগ্রহণমূলক সরকারের দিকে অগ্রসর হয়, সব দলকে একত্রিত করে, তাহলে ৪০ বছর পর শান্তি আসতে পারে দেশটিতে। কিন্তু তারা যদি ভুলপথে চলে, যা নিয়ে আমরা বাস্তবেই উদ্বিগ্ন, তাহলে আফগানিস্তানে বিশৃংখল এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে এক ভয়াবহ মানবিক সঙ্কট, বিশাল শরণার্থী সঙ্কট।’
ইমরান দাবি করেছেন যে, তালেবানরা সম্ভাব্য সঙ্কট এড়াতে আন্তর্জাতিক সহায়তা খুঁজছে, যা তাদেরকে বৈধতার দিকে সঠিক পথে ঠেলে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে তিনি সতর্ক করেছেন যে, আফগানিস্তানকে বাইরের শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তিনি বলেন যে, কোনো পুতুল সরকারকে আফগান জনগণ কখনো সমর্থন করেনি। সুতরাং ‘আমরা নিয়ন্ত্রণ করব’ এই চিন্তা দূরে রেখে তাদেরকে উৎসাহিত করা উচিত। পাক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার বুঝতে পারছে আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া তারা সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারবে না। সুতরাং আমাদের উচিত সহায়তার মাধ্যমে তাদেরকে সঠিক পথে নিয়ে যাওয়া।’
জাতিসংঘের সংস্থাগুলির মতে, তালেবানের ক্ষমতায় ফেরার আগে, দীর্ঘ সংঘাত, দারিদ্র্য, একের পর এক খরা, অর্থনৈতিক পতন এবং করোনাভাইরাস মহামারী ইতিমধ্যেই আফগানিস্তানের পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে, যেখানে ১৮ মিলিয়ন আফগান জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। এই পরিস্থিতিতে তালেবানরা দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলবে- সমালোচকদের এই অভিযোগের জবাবে ইমরান ১৯৮৯ সালে সোভিয়েতদের সেনা প্রত্যাহারের দিকে ইঙ্গিত করেন, যার ফলে ‘রক্তবন্যা’ ঘটেছিল।
মার্কিন বাহিনী চলে যাওয়ার পরে একই রকম রক্তপাতের আশঙ্কা করে ইমরান বলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমাদের বলেছে যে তালেবানরা পুরো আফগানিস্তান দখল করতে পারবে না এবং যদি তারা আফগানিস্তানকে সামরিকভাবে দখল করার চেষ্টা করে, তাহলে একটি দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ হতে পারে, যার জন্য আমরা ভীত ছিলাম কারণ আমরাই, যারা সবচেয়ে বেশি ভুগবে। এখন বিশ্বের উচিত তাদের একটি বৈধ সরকার গঠন এবং প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে সময় দেওয়া।’
ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে তালেবানরা তাদের আন্তর্জাতিক কুখ্যাতি লাঘবের চেষ্টা করেছে, বিশেষ করে নারী ও মেয়েদের মানবাধিকার সমুন্নত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং সাংবাদিকদের তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে। কিন্তু, নারীদের তালেবানদের কট্টরপন্থী অন্তর্র্বতীকালীন সরকার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, কিছু এলাকায় বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং তাদের শিক্ষা সীমিত করা হয়েছে। তালেবান শাসনের বিরুদ্ধে এবং নাগরিক অধিকারের জন্য বিক্ষোভ সহিংসভাবে দমন করা হয়েছে, সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার এবং মারাত্মকভাবে মারধরের খবর পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে ইমরান খান বলেছেন, ‘বাইরে থেকে কেউ আফগান মহিলাদের অধিকার এনে দেবে এটা ভাবা ভুল। আফগান নারীরা শক্তিশালী। তাদের সময় দিন। তারা তাদের অধিকার অর্জন করবে।’ তিনি বলেন, ‘সমাজে নারীদের জীবনে তাদের সম্ভাবনা পূরণের ক্ষমতা থাকা উচিত। পাকিস্তানে আমরা যা করেছি, তা হল আমরা আসলে দরিদ্র পরিবারকে মেয়েদের স্কুলে পড়ার জন্য উপবৃত্তি প্রদান করেছি কারণ আমরা মনে করি যে, যদি মেয়েরা, যদি মেয়েশিশু লেখাপড়া করে, যদি তারা শিক্ষিত হয়, তাহলে তারা পাবে তাদের নিজেদের অধিকার অর্জর করবে।’
ইমরান খান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তিক্ত সম্পর্ক, যা পাকিস্তানের জন্য ধ্বংসাত্মক এবং আফগানিস্তানের নতুন নেতাদের মোকাবিলা করতে যে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজছেন বলে জানান। তিনি এর আগে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার সমালোচনা করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, পাকিস্তান একটি প্রধান ন্যাটো বহির্ভূত মিত্র হওয়া সত্ত্বেও তালেবান আফগানিস্তান দখলের পর থেকে তিনি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে তার কথা হয়নি।
ইমরান বলেন, ‘আমি কল্পনা করবো তিনি খুব ব্যস্ত, কিন্তুযুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্ক শুধু একটি ফোন কলের উপর নির্ভর করে না, এটি একটি বহুমাত্রিক সম্পর্ক হওয়া দরকার।’ ইমরান মনে করেন না যে, আফগানিস্তানে যুদ্ধযুক্তরাষ্ট্রের সাথে গত ২০ বছর পাকিস্তান উপভোগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কের বিষয়ে মন্তব্য করে পাক-প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আফগানিস্তানে মার্কিন দখলের সময় ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক ছিল জঘন্য। আমরা ছিলাম ভাড়া করা বন্দুকের মতো।’
ইমরান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার বেসামরিক ও সামরিক সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি জনগণ বোমা বিস্ফোরণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দেশটি অর্থনীতির ১ শ’ ৫০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। ইমরান বলেছেন যে, তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্ককে দেখতে চান, যেমন ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এবং এক তরফা সম্পর্ক নয়, যেখানে তারা যুদ্ধে করার জন্য আমাদের অর্থ প্রদান করছে। আমরা একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক চাই।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন