কয়েক দিন ধরে পাঁচ বছর বয়সি মাহাথির মোহাম্মদ (৫) এর জ্বর। কখনো কখনো খিঁচুনি দিয়ে জ্বর, সর্দি-কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। এছাড়া পেটে ব্যথা বা পেট খারাপও হচ্ছে। এ রকম ৩ দিন হওয়ার পর আসগর আলী হাসপাতালের চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করালেও কম ছিল না জ্বর। করোনার কিছু উপসর্গের সঙ্গে জ্বরের উপসর্গ মিলে গেলেও, টেস্টে করোনা মেলেনি। ডেঙ্গুও নেগেটিভ। কি করবেন ভেবে পাচ্ছিল না অভিভাবকরা। জ্বর না কমায় এভাবে ১ সপ্তাহ যাওয়ার পর আরও বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়। এবার চিকিৎসক বলছেন, টাইফয়েডের লক্ষণ। আর এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এরই মধ্যে চলে গেছে বড় অঙ্কের অর্থ।
কয়েক দিন ধরে ২ বছর ৪ মাস বয়সি সিফা’র জ্বর। সর্দি-কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্টও আছে। শিফা’র মা তাসফিয়া জানান, বুকে-পিঠে তেল মালিশ, চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধও খাওয়ানো হয়েছে। তবু সমস্যা কমেনি। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়ে শিশুটি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতেই অনেক টাকা ব্যয় হয়েছে। এখন প্রয়োজন দ্রুত অন্য চিকিৎসা। করোনায় দীর্ঘদিন স্বামী কায়েসের ব্যবসা বন্ধ থাকায় পরবর্তী চিকিৎসা ব্যয় কীভাবে মিটাবেন এ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে সিফা’র পরিবার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমলেও চিন্তা বাড়াচ্ছে মৌসুমি সর্দি-কাশি রোগটি। আবার দীর্ঘদিন করোনার কারণে মানুষের আয় না থাকায় এমনিতেই বিপর্যস্ত। এরপর আবার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যদের জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে নানান পরীক্ষায় বিপাকে অর্থ, কষ্টে থাকা অনেক পরিবার। চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতেও প্রতিদিন বাড়ছে জ্বর, সর্দি, কাশি, গায়ে-হাতে ব্যথা নিয়ে আসা রোগীদের ভিড়। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কিছু মানুষের করোনা ও ডেঙ্গু ধরা পড়লেও অধিকাংশই ভাইরাল ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত। আবার কোথাও কোথাও ভুল চিকিৎসা হচ্ছে। মৌসুমি এ রোগটির চিকিৎসার খরচ জোগাতে পরিবারগুলো হিমসিম খেতে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, জ্বর-সর্দি-কাশির তীব্রতা থাকছে চার থেকে ১০ দিন। জ্বর সেরে গেলেও শুকনো কাশি, দুর্বলতা ভোগাচ্ছে অনেককে। অন্যান্য ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই এ ক্ষেত্রেও একসঙ্গে পরিবারের একাধিক সদস্য জ্বর-সর্দি-কাশিতে ভুগছেন। অনেকের গলাব্যথাও হচ্ছে। তাই রোগটি না কমা পর্যন্ত নিজেকে আলাদা করে অন্তত ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। এছাড়া ঘরে ও বাইরে অবশ্যই মাস্ক পরার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন তারা।
অপরদিকে জ্বর কিংবা ঠান্ডা মানেই করোনা নয়। তাই শুধু এমন লক্ষণ দেখা দিলেই হাসপাতালে না ছোটার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, জ্বর হলেই আতঙ্কিত না হয়ে, হতে হবে সচেতন। তবে টানা জ্বর, শুকনা কাশি ও শ্বাসকষ্ট করোনার লক্ষণ।
সূত্র মতে, গত কিছুদিন থেকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে নেই আবহাওয়া। এই রোদ, এই বৃষ্টি। খেয়ালি আবহাওয়ার সঙ্গে ঋতু ফাঁদে চারদিকে বাড়ছে সর্দি-কাশির সঙ্গে জ্বরের মতো মৌসুমি রোগ। ঘরে-বাইরে অনেকেই খুকখুক করে কাশছে। কেউবা নাক টানছে। দিনের তাপমাত্রা বাড়ছে-কমছে। কিন্তু গভীর রাত কিংবা ভোরে ঠান্ডা বাড়ছে। সাধারণত সন্ধ্যার পর থেকে গরম-গরম ভাব দেখে অনেকেই ঘরে ফ্যান বা এসি চালিয়ে রাখছেন। রাতে ঘুমানোর সময়েও তা বন্ধ করা হয় না। ফলে গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত তাপমাত্রা আরও কমলে চট করে সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছেন সব বয়সি। অনেকে ঠান্ডা পানি কিংবা ফ্রিজে রাখা কোমল পানীয় খেয়েও সর্দি-জ্বর ডেকে আনছেন।
বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ইউজিসি প্রফেসর ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেছেন, হঠাৎ করেই গত কিছুদিন থেকে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সীদের মধ্যে জ্বর-কাশি, হাঁচি-সর্দির উপসর্গগুলো বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে এ নিয়ে জনগণের আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। সচেতন থাকতে হবে। তিনি বলেন, জ্বর কিংবা ঠান্ডা মানেই করোনা নয়।
তবে এই সময়ে গলাব্যথা, খুসখুস ভাব, নাক বন্ধ বা অনবরত হাঁচি, মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, শরীর ম্যাজম্যাজ, দুর্বল লাগা ও ক্ষুধামন্দা দেখা দিলে চিকিৎসা করাতে হবে। উপসর্গে সাইনাস, টনসিলে প্রদাহ হতে পারে। সতেজ ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পানের পরামর্শ দিয়েছেন ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ। একই সঙ্গে আদা-লং-এলাচ-লেবু চা, তুলসী পাতা, মধু ও লেবুর রসসহ দেশিয় ফলের রস পান করার জন্যও বলেছেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নবজাতক ইউনিটের সাবেক বিভাগীয় প্রধান শিশু বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা জানান, শিশুদের জ্বর-কাশি, হাঁচি-সর্দি বেশি হচ্ছে। তবে সব বয়সির মধ্যেই এ উপসর্গগুলো দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের উপসর্গ নিয়ে আসা অনেক শিশুর ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে। এছাড়া অনেক রোগী ভাইরাল ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে আসছেন। এ ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জারও মহামারি ঘটানোর ক্ষমতা রাখে। তিনি বলেন, লক্ষণগুলো দেখা দিলেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বাসায় পর্যাপ্ত তরল খাবার নিশ্চিত করতে হবে। রোগী দুর্বল হলে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এক-দুদিন হলেই পরীক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত। তবে ভাইরাল ইনফ্লুয়েঞ্জা বর্ষায় বাড়ে, একই সঙ্গে ঋতু পরিবর্তনের কারণেও এমনটা হয়। এটা নিয়ে ভয়ের তেমন কোনো কারণ নেই।
ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, এ সময়ে বিশেষ করে শূন্য থেকে দেড়-দুই বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে উপসর্গগুলো বেশি দেখা দিচ্ছে। তবে যেসব শিশু মায়ের দুধ খায় তাদের খুব বেশি কাবু করতে পারে না। তিনি বলেন, অনেক শিশু চার-পাঁচ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে মনে রাখতে হবে, উপসর্গগুলো থাকলেও অনেক শিশু প্রাণচাঞ্চল্য থাকে। কিন্তু নাক দিয়ে পাতলা সর্দি পড়ে। বুকের ভেতর এক ধরনের আওয়াজ হয়। অক্সিজেন কমে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অক্সিজেন কমে গেলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। অভিভাবকদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। তিনি বলেন, শিশুর প্রতি যত্ন নিতে হবে, অবহেলা নয়। শিশুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, বর্তমানে হাসপাতালের আউটডোরে বেশির ভাগ শিশুই জ্বর-সর্দি-কাশি নিয়ে আসছে। হাঁচি-কাশির সঙ্গে শরীরে তীব্র ব্যথাও হচ্ছে। এক্ষেত্রে যথাযথ চিকিৎসার সঙ্গে পর্যাপ্ত পানি, ফলমূল, শাক-সবজি খেতে হবে। নিজে থেকে কোনো ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া একেবারেই ঠিক হবে না। এতে সমস্যা বাড়তে পারে।
রাজধানীর শিশু হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর শফি আহমেদ মুয়াজ জানান, জ্বর-সর্দি-কাশির উপসর্গ নিয়ে অনেক শিশু রোগী হাসপাতাল আউটডোরে আসছেন। কয়েকদিন থেকে চাপ বাড়ছে। প্রতিদিনই হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন