বিনিয়োগের অন্যতম চালিকাশক্তি ব্যাংক খাত। উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহের কারণে বিগত কয়েক বছর ধরে এ খাতটি নাজুক হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র বিনিয়োগের অভাবের কারণেই নয়, এ খাতে বেসুমার দুর্নীতি ও হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের কারণে খাতটিতে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে ব্যাংকগুলো যেমন মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলছে, তেমনি এগুলোর টিকে থাকতেও সংগ্রাম করতে হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর আয়ের মূল উৎস হচ্ছে, আমানতকারীর আমানত। তা সংগ্রহ করে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সুদের বিনিময়ে বিনিয়োগ করা। এটি একটি প্রক্রিয়া যার গতি যদি শ্লথ হয়ে পড়ে, তবে এর প্রতিক্রিয়া দেশের গোটা অর্থনীতির উপর পড়ে। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও বিনিয়োগের মন্দাবস্থা থেকে প্রতীয়মান হয় এই প্রক্রিয়া যথাযথ কার্যকর অবস্থায় নেই। ব্যাংকগুলোতে আমানতকারীদের অর্থের পাহাড় জমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো এখন তারল্য সংকটে ভুগছে। এক লাখ কোটি টাকারও বেশি অর্থ অলস পড়ে আছে। অথচ স্বাভাবিক নিয়মে ব্যাংকে এই বিপুল অংকের অর্থ পড়ে থাকার কথা নয়। বিনিয়োগ এখন এতটাই মন্দাবস্থার মধ্যে পড়েছে, এই অর্থ কোনো কাজে আসছেনা। ব্যাংকগুলো তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য ঋণের সুদ প্রায় অর্ধেক কমিয়েও বিনিয়োগকারীদের উৎসাহী করে তুলতে পারছে না।
দেশের অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই তা বহমান। মন্দার এই পরিস্থিতি বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন মানুষও তা বুঝতে পারে। তারা যখন দেখে, লাভের আশায় ব্যাংকে জমা রাখা অর্থের লাভ বা সুদ দিন দিন কমছে, তখন বুঝতে পারে দেশের অর্থনীতি ভাল যাচ্ছে না। এমনকি জমাকৃত অর্থের সুদের হার যখন মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হয় এবং ব্যাংকগুলো তাদের খরচ পোষানোর জন্য হিডেন বা গুপ্ত চার্জের নামে জমাকৃত অর্থ থেকে টাকা কেটে রাখে, তখন অর্থনীতির দুরবস্থার কথা তাদের বুঝতে বাকি থাকে না। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ৬.১ শতাংশ হলেও ব্যাংকের আমানতের সুদ কমিয়ে করা হয়েছে ৫.৪৪ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকে আমানতকারীরা যে লাভের আশায় সঞ্চয় করেন তাদের প্রায় এক শতাংশ হারে লোকসান গুনতে হচ্ছে। এর উপর ব্যাংকগুলো আমানতকারীর অজান্তে বিভিন্ন সার্ভিস চার্জ কেটে নেয়ার নামে অর্থ লোপাট করছে। পেনশন ভোগীদের কথা যদি ধরা হয়, তবে দেখা যায় তারা যে লাভের আশায় ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন, সে আশা পূর্ণ হচ্ছে না। অর্থাৎ ব্যাংকে আমানত হিসেবে তারা লাভের পরিবর্তে লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ব্যাংকগুলো তাদের লোকসান কাটানোর জন্য এখন সরকারি সঞ্চয়পত্র ও বন্ডে বিনিয়োগ করা শুরু করেছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ব্যাংক খাতেও চরম মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কি, তা বোধকরি তারা ছাড়া আর কেউ জানে না। সরকারের তরফ থেকে কাগজে-কলমে মাথাপিছু আয় ১৩১৬ ডলার বলা হলেও, তা জনসংখ্যার ক্ষুদ্র অংশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। জনসংখ্যার বৃহৎ অংশ এর বাইরে রয়ে গেছে। গত ৩ অক্টোবর বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে হতদরিদ্র জনসংখ্যা কমলেও এখনও দুই কোটি লোক হতদরিদ্র রয়ে গেছে। তারা দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করতে পারেনি। সাধারণত যার দৈনিক আয় ১.২৫ ডলার নয়, সে দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়ে যায়। আর দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করা মানে এই নয়, সে ভাল আছে বা ১৩১৬ ডলার আয় করছে। দেশে এমন লোকের সংখ্যাই বেশি। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশে বিনিয়োগ না হলে বা বৃদ্ধি না পেলে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হওয়া অসম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক আমানতের সুদ এবং ঋণ প্রদানের সুদের হার কমিয়েছে। বিশেষ করে যেখানে বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তারা ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদ শতকরা ১৬ থেকে ১৮ ভাগ থেকে কমানোর জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবী করে আসছিল, সে মোতাবেক ব্যাংকগুলো ধারাবাহিকভাবে ১০.৩২ শতাংশে নামালেও তেমন সাড়া পাচ্ছে না। বিনিয়োগে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হচ্ছে না। এ হিসাব থেকে বোঝা যাচ্ছে, দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি অত্যন্ত মন্দাবস্থার মধ্যে রয়েছে। বিনিয়োগের এই অনুৎসাহী পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা একটি ইংরেজি দৈনিককে বলেছেন, দেশের ব্যবসায়ীরা ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ বা ‘দেখি কী হয়’ এমন এক প্রবণতার মধ্যে রয়েছে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের ধীরগতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব তাদের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে তারা দেখেছে, অনেকে পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুবিধা এবং গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ না পাওয়ায় ব্যাংক থেকে শত কোটি টাকা লোন নিয়েও কারখানা চালু করতে পারেনি। এসব উদাহরণ তাদের সামনে থাকায় তারা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জড়োসড়ো হয়ে রয়েছে। আবার তারা বসেও থাকছে না। অনেকে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না পেয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে পাঁচ-ছয়টি দেশীয় বড় প্রতিষ্ঠান আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কারখানা স্থাপন করে ব্যবসা শুরু করেছে। বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় কেউ কেউ আমদানির নামে ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারও করে দিচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিগত কয়েক বছরে দেশ থেকে চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। এখনও পাচার হচ্ছে।
দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতির চরম মন্দাবস্থার কথা সরকারের চেয়ে বেশি কেউ জানে না। তার কাছে সব ধরনের ডাটা ও তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। রেওয়াজ অনুযায়ী বিনিয়োগের এই মন্দাবস্থা কোনো সরকারই স্বীকার করে না। এ কথা অনস্বীকার্য, সব সরকারই চায় দেশে বিনিয়োগ বান্ধব পরিস্থিতি বিরাজ করুক এবং বিনিয়োগ বাড়–ক। এটা নির্ভর করে সরকারের অর্থনৈতিক নীতি, পরিকল্পনা, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা, দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ ও সুশাসন নিশ্চিত করার ওপর। বর্তমানে এসব মৌলিক উপাদানের অভাব যে দেশের অর্থনীতির মূল নিয়ামক শক্তি বিনিয়োগে চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তাতে সন্দেহ নেই। তা নাহলে সরকারের উদাত্ত আহ্বান সত্ত্বেও বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং অর্থনীতির চাকা সচল হবে না কেন? সরকার নিশ্চয়ই অর্থনীতির মূল প্রতিবন্ধকগুলো সম্পর্কে অবহিত। এই প্রতিবন্ধক দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান থাকার কারণেই বিনিয়োগসহ অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি নেতিবাচক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা এই বন্ধ্যাত্ব সরকারের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কেবল কিছু প্রকল্পের উন্নয়নকে যদি সার্বিক উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়, তবে তা সুষম অর্থনীতির সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। এ নিয়ে উল্লাস প্রকাশ সত্যকে আড়াল করার শামিল। আমরা মনে করি, সরকারকে এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। হাওয়ায় না ভেসে মাটিতে পা রেখে ধীরস্থিরভাবে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে চিন্তা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ নেয়াই উচিত ও সঙ্গত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন