বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

৯/১১ এর পর আমেরিকায় মুসলমানদের অবস্থা করুণ : ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম | আপডেট : ৭:৫১ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

৯/১১ বা নাইন-ইলেভেনের পর আমেরিকায় মুসলমানদের অবস্থা কেমন করুণ হয়েছিল সেটি আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। ২০০৫ সালে গ্রিনকার্ড পেয়ে আমি সপরিবারে আমেরিকা যাই। এর আগে ১৯৯৬ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের আমন্ত্রণে আমরা মার্কিন মুল্লুকের প্রায় ১৪টি অঙ্গরাজ্য সফর করি। অপর সদস্য ছিলেন শাহ্ আব্দুল হান্নান। তখন তিনি বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। ঐ সফরের শিরোনাম ছিল, Muslims in America. অর্থাৎ আমেরিকায় মুসলমানরা কেমন আছে, সেটি আমাদেরকে দেখানো। ১৯৯৬ সালে এতগুলো অঙ্গরাজ্য সফর করে আমরা দেখলাম, বিদেশি মানুষদের ড্রিমল্যান্ড (স্বপ্নের দেশ) আমেরিকায় মুসলমানরা ভালই আছে। কিন্তু তার ৯ বছর পর ২০০৫ সালে গ্রিনকার্ড নিয়ে যখন সেই স্বপ্নের দেশে গেলাম তখন সেটি দুঃস্বপ্নের মতো মনে হলো। দুটো উদাহরণ দিচ্ছি।

সম্ভবত ২০০৫ সালের জুলাই কি আগস্ট মাস। নিউইয়র্ক থেকে এক ট্রেনে উঠেছি। জ্যাকসন হাইটস পার হওয়ার পর হঠাৎ এক অনির্ধারিত স্থানে ট্রেনটি থেমে গেল। অনেক যাত্রীই নেমে গেলেন, বিষয়টি কী সেটি জানতে। প্ল্যাটফরম এবং ট্রেন জুড়ে চাঞ্চল্য। পুলিশের ঘন ঘন হুইসেলের আওয়াজ। এমন সময় মাইক্রোফোন থেকে ঘোষণা করা হলো, যেসব যাত্রী ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফরমে অযথা ঘোরাঘুরি করছেন তারা কমপার্টমেন্টে নিজ নিজ আসনে গিয়ে বসুন। জরুরি তল্লাশি চলছে। সবাই গিয়ে আসনে বসলাম। বিশাল বপুর দুই পুলিশ আমাদের কামরায় এলেন। কিছুক্ষণ সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তারপর নেমে গেলেন। এভাবে আরও অনেক কামরায় তারা তল্লাশি চালান। প্রায় ৩৫ মিনিট তল্লাশির পর ট্রেনটি ছেড়ে দিল। জানা গেল, তাদের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টে খবর ছিল যে, ঐ ট্রেনে নাকি একজন ‘ইসলামী সন্ত্রাসী’ ট্র্যাভেল করছিল। তাকে ধরার জন্যই নাকি ঐ আয়োজন। কিন্তু ব্যাপক তল্লাশির পরও তাকে ধরা যায়নি।

দ্বিতীয় ঘটনা। পরের বছর ২০০৭ সাল। মালয়েশিয়ান এয়ার লাইনস যোগে আমি সপরিবারে বাংলাদেশে থেকে নিউ জার্সি যাচ্ছি। আমাদেরকে বিমান বন্দর থেকে নিয়ে যাবে অনুজ প্রতিম সালাউদ্দিন। বিমান থেকে চেক আউটের জন্য নির্ধারিত রুমে বসলাম। যথারীতি পাসপোর্টসহ আমাদের ট্র্যাভেল ডকুমেন্টস নিয়ে নেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পর আমার স্ত্রীর কাগজপত্র ওকে হলো এবং সেগুলো তাকে ফেরত দেওয়া হলো। একটু পর আমি জানতে চাইলাম, আমাকে ওকে করা হচ্ছে না কেন? বলা হলো, ‘প্লিজ ওয়েট’। প্রতীক্ষার আর শেষ হয় না। এভাবে একঘণ্টা, দুই ঘণ্টা কেটে গেল। আমি যতবারই খবর নিতে যাই, ততবারই বলা হচ্ছে ‘প্লিজ ওয়েট’। অবশেষে আড়াই ঘণ্টা পর আমার ডাক পড়লো। চেক আউটের সময় কোনো যাত্রীর দেহ তল্লাশি করা হয় না। কিন্তু হোমল্যান্ড সিকিউরিটির এক বিশাল দেহী অফিসার নিবিড়ভাবে আমার দেহ তল্লাশি করলেন। কিছুই না পেয়ে আমার কাগজপত্র ওকে করে আমাকে ছেড়ে দিলেন। আমি ‘দৈনিক ইনকিলাবের’ অ্যাসোসিয়েট এডিটর। আমি হোমল্যান্ডের অফিসারকে ইনকিলাবের আইডি কার্ড দেখালাম এবং জানতে চাইলাম, কেন এতক্ষণ আমাকে আটকে রাখা হলো। অফিসার বললেন, ‘সরি, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। তোমার মতো দেখতে একজন ইসলামী সন্ত্রাসী এই বিমানে যাত্রী ছিল। স্টকহোম থেকে তাকে আমরা ট্র্যাক করছি। তোমাকে আটকে রেখে আমরা সেই লোকটার ডিটেইলড ইনফরমেশন নিয়েছি। যখন কনভিনসড হলাম যে, ঐ লোক তুমি নও, তখন তোমাকে ছেড়ে দিলাম।’

এয়ার পোর্টের বাইরে এসে আমি দেখি যে, আমাকে নেওয়ার জন্য যে গাড়ি এসেছিল অস্বাভাবিক বিলম্ব দেখে তারা ভেবেছে যে, আমরা হয়তো ঐ বিমানে আসিনি। তাই তারা ফিরে গেছে। বাধ্য হয়ে আমরা একটি ট্যাক্সি ক্যাব নিলাম।
দুই

নাইন-ইলেভেন পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। ৯/১১ এর সেনাপতি সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বলেছিলেন যে, পেশী শক্তির, অর্থাৎ সামরিক শাক্তির জোরে তিনি বিশ্বের অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে গণতন্ত্র ছড়িয়ে দেবেন। কিন্তু হয়েছে হিতে বিপরীত। যেসব দেশে আমেরিকা গায়ের জোর দেখিয়েছে এবং তারপর পিছু হটেছে সেই সব দেশে বরং কর্তৃত্ববাদী শাসনের জগদ্দল পাথর জেকে বসেছে। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশে গণতন্ত্র নাই। ইরাক এবং লিবিয়ায় ব্যক্তিস্বৈরতন্ত্রের উৎখাত হয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসন চেপে বসেছে। সিরিয়াতেও তারা বাশার আল আসাদের একনায়কতন্ত্র অবসানের নাম করে হামলা করেছিল। রাশিয়া পাল্টা হামলা করে মার্কিনী হামলা বানচাল করে দেয়। মাঝখানে কাজের কাজ এই হলো যে, বাশার আল আসাদের স্বৈরতন্ত্র বহাল তবিয়তে আছে।

নাইন-ইলেভেন খোদ আমেরিকাকেও বদলে দিয়েছে। আমেরিকাকে বলা হয়, ‘ল্যান্ড অব দ্য ইমিগ্র্যান্টস’, অর্থাৎ অভিবাসীদের বাসস্থান। বাস্তবিকই তাই। আপনি যদি ম্যানহাটনের কোনো এভিনিউ দিয়ে হাঁটেন তাহলে মুহূর্তের মধ্যেই হরেক কিসিমের মানুষ দেখবেন। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষ সেখানে দেখা যায়। বিশ্বের ৬৪টি মুসলিম দেশের মানুষও আপনি সেখানে পাবেন। অতীতে তারা সিনা টান করেই চলতেন। কিন্তু ৯/১১ এর পর আর সেই অবস্থা নাই।

৯/১১ এর পর সরকার ‘প্যাট্রিয়ট’ নামে একটি আইন পাশ করেছে। এই আইনের বলে সরকার যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারী করতে পারে। এই নজরদারীর লক্ষ্য যদিও বহিরাগত, তবুও সেই বহিরাগতদের মধ্যেও প্রধান টার্গেট মুসলিম সম্প্রদায়। ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক এফবিআই নিজস্ব লোক পাঠিয়েছে মসজিদে অথবা মুসলিমদের সভায়। সন্ত্রাসী ধরার নামে চলছে ‘স্টিং অপারেশন’। স্টিং অপারেশন বলতে বোঝায়, বিভিন্ন ধরনের অপরাধী শনাক্ত করা এবং তাদেরকে আইনের আওতায় আনা। এজন্য যে নজরদারী বা অনুসন্ধান চালানো হয় সেটি প্রায়শই গোপনে করা হয়। তাই এটি হয় সাধারণত ‘কভার্ট অপারেশন’। নাইন-ইলেভেনের পর আমেরিকাতে স্টিং অপারেশনের নামে মুসলমানদেরকেই টার্গেট করা হয়।

একটু আগে আমি বাংলাদেশের যে বাংলা দৈনিকটির কথা উল্লেখ করলাম, ঐ দৈনিকটির আলোচ্য রিপোর্টে ‘সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেসের’ এক রিপোর্টের রেফারেন্স দিয়ে বলা হয়েছে যে, আমেরিকার মুসলিমদের জন্য নামাজে সমাবেত হওয়া বা ধর্মীয় পোশাক পরাও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন নাকি মার্কিন পুলিশের জনপ্রিয় শ্লোগান হলো, ‘ইফ ইউ সি সামথিং, সে সামথিং’। অর্থাৎ আপনি সন্দেহজনক কিছু দেখলে পুলিশে খবর দিন। আলোচ্য রিপোর্টে বলা হয়েছে, মুসলিমরা এমনিতেই মার্কিনীদের চোখে সন্দেহের বস্তু। তার ওপর পুলিশের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে এক প্রতিবেশী অন্য প্রতিবেশীর ওপর শুধু যে নজর রাখছেন, তাই নয়, সামান্য সন্দেহ হলেই পুলিশকে ফোন করে খবর দিচ্ছেন। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ জানিয়েছে, এই নাগরিক নজরদারী রীতিমত ‘সামাজিক বৈকল্যে’ পরিণত হয়েছে। কেউ একজন ভুলে নিজের ব্যাগ ফেলে গেছে, অমনি পুলিশে ফোন, এখানে কেউ বোমা রেখে গেছে।

তিন
নিউইয়র্কে সাব ওয়ে বলতে সাধারণত মাটির নিচে ট্রেন বা আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন বা পাতাল রেল বোঝায়। সাব ওয়ের প্ল্যাটফরমে দেখা গেল, কেউ একজন দুই হাতের আঙ্গুলে কিছু গুনছেন। অমনি পুলিশে খবর গেল যে, এক ব্যক্তি ট্রেনে যাত্রীর সংখ্যা গুনছেন। পুলিশ এসে লোকটিকে ধরে দেখলো যে, ঐ ব্যক্তি তাসবিহ তাহলিল করছেন বা তাসবিহ টিপছেন।

ঐ রিপোর্ট শেষ করা হয়েছে এভাবে, ‘৯/১১ এর পর বহিরাগতদের প্রতি ভীতি ও সন্দেহের ফলে যে ঘৃণার সংস্কৃতি মার্কিন মুল্লুকে ছড়িয়ে পড়েছে, ১৫ বছর পর তাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো এক রাজনীতিকের উত্থান ঘটিয়েছে। মুসলিম ও অন্য বহিরাগতদের বিরুদ্ধে ধিক্কারজনক শ্লোগান উচ্চারণ করেই ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।’

আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা পাততাড়ি গুটিয়েছে। এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন পরাশক্তি ছিল তখন তারাও ১০ বছর অকুপাই করেছিল। তার আগে বৃটেন বিশ্বশক্তি ছিল। সেই বৃটেনও তিনবার আফগানিস্তান দখল করেছিল। কিন্তু টিকতে পারেনি। তিনবারই পিছু হটতে হয়েছে। তাই আমার মতে, আফগানিস্তান এবার সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হলো। এখন তাদের দেশ গড়ার পালা।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি ভালো কাজ করেছেন। এখন দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভালো কাজ করার সময় এসেছে। সেটি হলো, আফগানিস্তানের মতো ইরাক এবং সিরিয়া থেকে সমস্ত সেনা প্রত্যাহার। গত ২৬ জুলাই ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা কমালের সাথে ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন যে, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ইরাক থেকে সমস্ত মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আফগান অভিযানের ১ বছর ৫ মাস পর ২০০৩ সালের ১৯ মার্চ আমেরিকা ইরাকে সামরিক অভিযান চালায় এবং তেলসমৃদ্ধ দেশটি পদানত করে। সেই থেকে বিগত ১৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা ইরাক দখল করে আছে। ইরাকে সামরিক হামলার দ্বিবিধ উদ্দেশ্য দেখানো হয়। প্রথমত ইরাকে মজুদ গণবিধ্বংসী অস্ত্র। আর দ্বিতীয়টি হলো সাদ্দাম হোসেনের রাজত্বের অবসান এবং ইরাকী জনগণকে মুক্ত করা।

জাতিসংঘ কর্তৃক তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করেও ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি। অথচ, এটাই ছিল ইরাক আক্রমণের প্রধান অজুহাত। সেটি যখন ডাহা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে তখন আমেরিকার উচিৎ, করজোড়ে মাফ চেয়ে ইরাক থেকে তল্পীতল্পা গুটানো। মার্কিনীদের ইঙ্গিতে ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করা হয়। তারপর মার্কিনীরা ১৫ বছর ধরে ইরাকে আছে কেন? সরকার পরিবর্তনের জন্যও মার্কিনীরা পেশী শক্তি প্রয়োগ করে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়ায় করেছে। প্রথমটি তিনটি দেশে সফল হয়েছে। শেষেরটিতে অর্থাৎ সিরিয়ায় ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রতিটি দেশেই তারা যুদ্ধাপরাধ করেছে এবং নির্লজ্জভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।

তাই আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে। এবার এসব দেশ, বিশেষকরে ইরাক এবং সিরিয়া থেকে হাত গুটাও, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মুক্তিকামী জনগণের এটাই সার্বজনীন দাবি।
E-mail: journalist15@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন