অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, বেসরকারি চাকরিজীবী, প্রবাসী এবং শ্রমজীবী কাউকে বাদ দেয়নি এহসান গ্রুপ। এমনকি বিধবা ও গৃহিণীর টাকাও আত্মসাৎ করেছে তারা। পরকালে মুক্তির দোহাই দিয়ে সুদবিহীন উচ্চ মুনাফার কথা বলে শুধুমাত্র যশোরের ১৬ হাজার মানুষকে নিঃস্ব করেছে এহসান গ্রুপ। আত্মসাৎ করেছে ৩২২ কোটি টাকা।
পরকালে মুক্তির দোহাই দিয়ে গ্রাহকদের বলা হয়েছিল, ব্যাংকে টাকা রাখা হারাম, এহসান গ্রুপে রাখা হালাল। বেশির ভাগ গ্রাহককে মাসিক মুনাফা এবং অল্প কয়েকজনকে মেয়াদ পূর্তিতে দ্বিগুণ টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেন সংস্থার মাঠকর্মী ও পরিচালকরা। কিন্তু টাকা গ্রহণের পরপরই সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা গা ঢাকা দেন। অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। টাকা না পাওয়া গ্রাহকের মধ্যে অনেকে মারা গেছেন; শয্যাশায়ী হয়েছেন কেউ। অভাব-অনটনের মধ্যে দিন পার করছেন অনেকে।
গচ্ছিত টাকা ফেরতের জন্য কয়েকজন মামলা করেছেন। অন্যরা একই পথে হাঁটছেন। যশোর শহরের বেজপাড়া চোপদারপাড়া এলাকার কাজী মফিজুল হক। তিনি পুলিশের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি বলেন, অবসর গ্রহণের পর হজ করি। হজ শেষে দেশে ফেরার পর শহরের দড়াটানা জামে মসজিদে নামাজ আদায় করতে যাই। সেখানকার ইমাম-মুয়াজ্জিন আমাকে জানান, ব্যাংকে টাকা রাখা হারাম। পরকালে জবাবদিহি করা লাগবে। তারা আমাকে বোঝাতে সক্ষম হন, এহসান গ্রুপে টাকা রাখলে হালাল হবে। এছাড়া ব্যাংকের চেয়ে বেশি লভ্যাংশ পাওয়া যাবে। তাই অবসরকালীন যে টাকা পাই, সেখান থেকে চার দফায় ৪০ লাখ দিই। প্রথমে ২০ লাখ, এরপর পাঁচ লাখ করে দু’বার এবং শেষে দশ লাখ টাকা দিই। লাখে মাসিক দেড় হাজার টাকা মুনাফা ৪-৫ মাস পাই। এরপর লভ্যাংশ দূরে থাক মূল টাকাও পাইনি। টাকা উদ্ধারে আদালতে মামলা করেছি।
চোপদারপাড়া এলাকার বিধবা জুলেখা বেগম (৬৮)। তিনি গচ্ছিত রাখেন প্রায় ১৬ লাখ টাকা। টাকা জমা দেওয়ার কিছু রশিদ হারিয়ে গেছে। তবে ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার রশিদ আছে তার কাছে। তিনি বলেন, স্থানীয় জামে মসজিদের হুজুর ইমদাদের মাধ্যমে এহসান গ্রুপের নাম শুনি। ইমদাদের মাধ্যমেই এহসান গ্রুপে টাকা রাখি। এর আগে সমিতির নিয়মে ৫০-১০০ টাকার কিস্তি চালাতাম। সেখান থেকে একবার ১৮ হাজার টাকা উত্তোলন করি। এভাবে বিশ্বাস হয়। আমি ছাড়াও এলাকার অনেক মানুষ এহসান গ্রুপে টাকা জমা রাখতো। আলেম-ওলামার প্রতি অগাধ বিশ্বাসের কারণে আমরা অনেক কষ্টের টাকা সেখানে জমা রেখেছি। বছর খানেক লভ্যাংশ পেয়েছি। লভ্যাংশ এবং মূল টাকা ফেরত না পেয়ে গত বছরের অক্টোবরে এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ ১৮ জনকে আসামি করে মামলা করি।
শহরের রামকৃষ্ণ রোড এলাকার বাসিন্দা মুস্তফা দ্বীন মোহাম্মদ। তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। এহসান গ্রুপের অন্যতম পরিচালক মুফতি আতাউল্লাহ তাকে এই খাতে টাকা বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেন। মুস্তফা ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা রাখেন। কিন্তু এক টাকাও ফেরত পাননি। আতাউল্লাহর বাবা ছিলেন মুস্তফার শিক্ষাগুরু। মুফতি আতাউল্লাহর চাচাতো ভাই মাওলানা জোনায়েদ ও আইয়ুবও তার পরিচিত এবং টাকা রাখতে তারা প্ররোচনা দেন। ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এতদিন মামলা করেননি। কিন্তু সম্প্রতি ওই প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের আটক দেখে তিনিও মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন।
শহরের বাড়ি বিক্রি করে ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন রহিমা বেগম। একেবারে নিঃস্ব রহিমা এখন শহরতলীর ঝুমঝুমপুর ময়লাখানা এলাকার ভাঙা ঘরে বসবাস করেন। ইতোমধ্যে দুই দফা তার স্ট্রোক হয়েছে। সারাদিন শুয়েই থাকেন। এক ছেলে দিনমজুর; প্রায়ই কাজ থাকে না তার। রহিমা মাঝেমধ্যে ভিক্ষাও করেন। তিনি তার কষ্টের টাকাগুলো ফেরত চেয়েছেন।
যশোর শহরের শংকরপুরে ভিটেবাড়ির আট শতক জমি বিক্রির ১২ লাখ টাকা এবং নিজের জমানো এক লাখ ২৫ হাজার টাকাসহ ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা এহসান গ্রুপে রাখেন আফসার উদ্দিন। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে টাকা জমা রাখার পর ছয় মাস মুনাফা পান। এরপর গচ্ছিত টাকা ফেরত দেওয়া নিয়ে টালবাহানা শুরু করে প্রতিষ্ঠান। তিনি টাকা আদায়ে মামলা করার জন্য একজনকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছেন।
শহরের পুরাতন কসবা এয়ারপোর্ট রোড এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শামসুর রহমান জমি বিক্রির ১৫ লাখ টাকা এহসানে রাখেন। তিনি বলেন, এয়ারপোর্ট রোডের কুন্দিয়ানে জামে মসজিদের ইমাম, শহরের নীলগঞ্জ তাঁতিপাড়া এলাকার বাসিন্দা ওমর ফারুকের প্ররোচনায় প্রথমে দশ লাখ এবং পরে আরও পাঁচ লাখ গচ্ছিত রাখি। আমাকে বলা হয়, লাখে প্রতিমাসে এক হাজার ২০০ টাকা মুনাফা দেওয়া হবে। ৮-৯ মাস নিয়মিত লভ্যাংশ পেয়েছি। এরপর আর পাইনি। জমি বিক্রির টাকা প্রথমে সোনালী ব্যাংকে রেখেছিলাম। ওই ইমাম কীভাবে জানতে পারেন আমার কাছে টাকা আছে। ইসলামের নানা ব্যাখ্যা দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে এহসানে গচ্ছিত রাখতে বাধ্য করেন। আমার সবশেষ। এ ঘটনায় আমি মামলা করবো।
প্রতারণার শিকার গ্রাহকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ধর্মের দোহাই দিয়ে মসজিদের ইমাম ও খাদেমদের একটি অংশ এহসান গ্রুপে বিনিয়োগের জন্য গ্রাহক তৈরি করতেন। যশোরের প্রায় ১৬ হাজার গ্রাহকের ৩২২ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেয় তারা। হাজার হাজার গ্রাহক এহসান গ্রুপের প্রতারণায় জীবনের সব সঞ্চয় হারিয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন