গত কিছুদিন ধরে ছাত্রীদের ওপর হামলা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। সন্ত্রাসী কর্তৃক নির্মম আক্রমণের শিকার সিলেটের খাদিজা বেগম নার্গিস যখন হাসপাতালে জীবন-মরণ যুদ্ধে লিপ্ত, তখন খবর বেরিয়েছে, লক্ষ্মীপুরে কলেজ ছাত্রী ফারহানা আক্তারকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে দুবর্ৃৃত্তরা। শুক্রবার রাত ন’টার দিকে লক্ষ্মীপুর শহরের শাখারিপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয়দের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ঘটনার দিন বিকেলে বাসা থেকে বের হয়ে বাস কাউন্টারে টিকিট না পেয়ে পুনরায় বাসায় ফিরতে গেলে পথিমধ্যে দুবর্ৃৃত্তরা তাকে কুপিয়ে জখম করে। ঘটনার কারণ হিসেবে আক্রান্ত ফারহানা অভিযোগ করেছে, একটি এনজিও’র কর্মকর্তার সাথে বিয়ে হবার পর তাকে মোবাইলে হুমকি দিয়ে লক্ষ্মীপুর আসতে নিষেধ করা হয়েছিল। তিনি মনে করেন, হুমকিদাতাদের ভাড়াটিয়ারাই এ আক্রমণ করেছে। সাম্প্রতিক এসব ঘটনার আগেও এধরনের পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছে। কিছু দিন আগে উইলস লিটল ফ্লাওয়ারের নবম শ্রেণীর ছাত্রী রিশা বখাটে যুবকের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়। একের পর এক ছাত্রীদের ওপর চলমান সহিংস ঘটনার প্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন ও জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দুই দিনের কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে প্রতীকী মানববন্ধন এবং সভা। কর্মসূচী ঘোষণা উপলক্ষে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, খাদিজা, রিশা, তনুর মত মেধাবী ছাত্রীদের ওপর বখাটে-সন্ত্রাসীদের হামলা আমাদের মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এ পরিস্থিতিতে আমরা নিশ্চুপ থাকতে পারি না।
সমাজের প্রকৃত চিত্র বুঝতে হলে মূলত নারীদের সার্বিক সুযোগ-সুবিধার দিকে দৃষ্টি দিতে হয়। পিছিয়ে থাকা নারীদের এগিয়ে আনতে সরকারের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় নারীরা নিজ দক্ষতা ও যোগ্যতায় অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষেত্রে তারা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এ চলার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে বখাটে শ্রেণী। এরই ধারাবাহিকতায় ঘটছে একের পর এক মর্মান্তিক ঘটনা। পরিস্থিতি কত মারাত্মক আকার ধারণ করেছে তা বোঝা যায় খোদ শিক্ষামন্ত্রীর কথাতেও। তিনি বলেছেন, ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর সারাদেশে ছাত্রীর উপর সন্ত্রাসী হামলার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ১৪টি শোকসন্তপ্ত পরিবারের কাছে ছুটে যাই। তিনি মনে করেন, কেবল আইনের মাধ্যমে এধরনের বর্বর ঘটনা নির্মূল সম্ভব নয়। এই প্রবণতা রোধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং অপরাধীদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে সমাজের সকল স্তরের জনগণের ভূমিকা রাখতে হবে। বলা বাহুল্য, এ ধরনের অপরাধের প্রতিবাদ শুরু থেকেই জনগণের মধ্য থেকে উঠেছে। ধরা পড়ার প্রায় সবক’টিই ঘটেছে জনসাধারণের সহায়তায়।এসব ঘটনা নারী বা ছাত্রীদের নিরাপত্তাহীনতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। নারীর প্রতি বিশেষত ছাত্রীদের প্রতি সহিংস হয়ে উঠার এ প্রবণতা অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার। একটি সমাজে নারী তার সম্মান নিয়ে চলতে পারবে না, এটা কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। সেই সাথে এটিও বিবেচ্য, সম্প্রতি যেসব ঘটনায় হত্যা বা হত্যা প্রবণতার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তা কার্যত আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়। তবে এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীর কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট গাফিলতি পরিলক্ষিত হয়। অপরাধী অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার অপসংস্কৃতির কারণে এধরনের নৃশংস ঘটনার প্রতিকার হচ্ছে না। কোনো সভ্য সমাজে এ পরিস্থিতি চলতে পারে না।
নারীর প্রতি সহিংসতা ও বর্বর আচরণ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এক্ষেত্রে জিরো টলারেন্সের কোন বিকল্প নেই। এ কথাও জানতে হবে, এসব ঘটনার মধ্যদিয়ে সমাজের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিষয়টি ফুটে উঠেছে। এখনই যদি এই অবক্ষয় ঠেকানো না যায়, তবে তা এক সময় ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া থেকে আমরা কেউই রেহাই পাব না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই পরিবার ও সমাজের সবাইকে সচেতন হতে হবে। পরিবার ও সমাজে নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় অনুশাসন এবং মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিতে হবে। অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করে তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন