বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ

কক্সবাজার থেকে শামসুল হক শারেক | প্রকাশের সময় : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৫:২১ পিএম

  • প্রত্যাবাসন বিলম্বিত ও মাদক ব্যবসা নির্বিঘ্ন করতে
  • এইচআরডব্লিউ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর নিন্দা

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করতে ও মাদক ব্যবসা নির্বিঘ্ন করতে সুদুরপ্রসারি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে শীর্ষ রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) সভাপতি মহিবুল্লাহকে (৫০) বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে উখিয়া কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার ইস্ট-ওয়েস্ট ১নম্বর ব্লকে তার নিজ অফিসে অজ্ঞাতনামা বন্দুকধারীরা গুলিকরে হত্যা করে।

নিহত মুহিবুল্লাহ আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস বা (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান ছিলেন। মিয়ানমারে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মহিবুল্লাহর ছিল অগ্রণী ভূমিকা।

তার এই হত্যাকাণ্ড রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সরকার যে মানবিকতা দেখিয়েছে এবং শান্তিপূর্ণ ও মর্যাদার সাথে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের যে প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে তা প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে বলেও মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।

গত সপ্তাহদেড়েক আগে কক্সবাজার উখিয়া ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফর করে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলার। মাত্র দুইদিন আগে কক্সবাজার সফর করে গেলেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জান খান কামাল ও আইজিপি ড. বেনজির আহমদ সহ ভিভিআইপিরা। ঠিক এর পর পর গতকাল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রকাশ্যে গুলি করে একজন শীর্ষ রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যার বিষয়টি বড় ধরনের প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আগে থেকেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ছিল কিছু এনজিদের ব্যাপারে। তাদের ইন্ধনে কয়েকটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ প্রত্যাবাসন বিরোধী ভূমিকা পালন করে আসছিল শুরু থেকেই। এদিকে মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে নেয়া প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও মানবিক সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকার প্রশংসিত হয়েছে। এই বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সরকার তাদের অধিকার ও মর্যাদার সাথে মিয়ানমারের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়ে আসছে। রোহিঙ্গাদের শীর্ষনেতা মহিবুল্লাহ সহ অধিকাংশ রোহিঙ্গারা সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আসছিল। তাই এই ধরনের প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার বিষয়টি প্রত্যাবাসন বিরোধী সুদুরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ বলেই মনে করা হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ২৯ সেপ্টেম্বর বুধবার এশা নামাজ শেষে ঘরে ফিরলে তিনজন মুখোশ পরা দুর্বৃত্ত খুব কাছে থেকে তাকে ৫ রাউন্ড গুলি করে। এতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। স্থানীয়রা দ্রুত কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন ।

ঘটনার পর মুহিবুল্লাহর ভাই প্রতক্ষদর্শী হাবিবুল্লাহ বলেন, সন্ত্রাসী আরসা গ্রুপের সদস্যরা ইর্ষাপরায়ন হয়ে মুহিবুল্লাহকে হত্যা করেছে। ওই সময় হত্যাকারী দলে ১৫/২০ সন্ত্রাসী ছিল। মাস্টার আব্দুর রহিম, লালু ও মুর্শেদসহ তিন জনের নামও বলেছেন তিনি।তিনি তাদের গ্রেপ্তারে দাবী জানান।

নিজেদের দ্বন্দ্বের কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে বলে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত ১৪ নম্বর ‘এপিবিএন’র পুলিশ সুপার নাইমুল হক।

এছাড়াও ক্যাম্পের ভেতরে কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে মুহিবুল্লাহর জোরালো ভূমিকা ছিল বলে জানা গেছে। এতে তারা মুহিবুল্লাহর উপর ক্ষিপ্ত ছিল।

খবর নিয়ে জানা গেছে, এখন থেকে ২০/৩০ বছর আগে ১৫জন সদস্য নিয়ে মিয়ানমারের আরাকানে গড়ে তোলেছিলেন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হউম্যান রাইটস বা এআরএসপিএইচ'।

রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ ১৯৯২ সালের পর বাংলাদেশি মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গেও গড়ে তেলেন যোগাযোগ। ধীরে ধীরে মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গা নেতার অন্যতম একজন হয়ে ওঠেন।

দক্ষ মুহিবুল্লাহ ২০১৭ সালের পর ব্যাপকহারে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসার পর ধীরে ধীরে বিদেশিদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। এমনকি জাতিসংঘ মহাসচিবসহ যত বিদেশি প্রতিনিধি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেছেন তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই রোহিঙ্গা প্রতিনিধি হিসেবে মুহিবুল্লাহ ও তার সঙ্গীদের সাক্ষাৎ করানো হয়েছে।

এই মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিবকেও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রসিডন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাৎ করানো হয়েছিল ১৭ সংখ্যালঘু দেশের প্রতিনিধিদের।

সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ১৭ দেশের যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২৭ প্রতিনিধি সাক্ষাৎ করেছিলেন সেই প্রতিনিধি দলেও রোহিঙ্গাদের পক্ষে জোরালো ভূমিকা পালন করেছিলেন এই মুহিবুল্লাহ।

এদিকে শীর্ষ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা বাংলাদেশ সরকারের উচিত বলে মন্তব্য করেছেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি। তিনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, মহিবুল্লাহর মৃত্যুতে তারা একজন প্রকৃত বন্ধুকে হারিয়েছেন।

রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য মহিবুল্লাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর ছিলেন, তার হত্যাকাণ্ড স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে স্বাধীনতার পক্ষে ও সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডসহ ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের উপর হামলা ও নির্যাতনের তদন্ত দাবি করেন।

মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, তিনি সবসময় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দয়াকে স্বীকার করেছেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের অধিকার চেয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যিনি ব্যক্তিগতভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাই এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবিলম্বে তদন্ত, বিচার এবং দোষী সাব্যস্ত করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

একইভাবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও রোহিঙ্গা নেতা

মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের নিন্দা জানিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ক্যাম্পেইনার সাদ হাম্মাদি এক বিবৃতিতে বলেছেন, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের শীর্ষ স্থানীয় একজন প্রতিনিধি ছিলেন মুহিবুল্লাহ। তিনি ক্যাম্পের সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। সমর্থন দিয়েছেন শরণার্থীদের মানবাধিকারের পক্ষে এবং তা সুরক্ষিত রাখায়। তার হত্যাকান্ড পুরো সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে। এখন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব তার এই হত্যাকান্ডের তদন্ত করা এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি বিচার করা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন