শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বিদেশি চ্যানেল বন্ধ : আমাদের যা করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০২ এএম

সরকার দেশে ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেলসহ বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ করেছে। গত ১ অক্টোবর থেকে এসব চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে। ভারতসহ বিদেশি চ্যানেলগুলো তাদের মূল কনটেন্ট বা অনুষ্ঠানের সাথে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারবে না, সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কারণেই এগুলো বন্ধ করা হয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে কেবল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন, অ্যাটকো, বিদেশি চ্যানেল ডিস্ট্রিবিউটর, আকাশ ডিটিএইচ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক শেষে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। অন্যদিকে, কেবল অপারেটর সংগঠনের পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপন ছাড়া বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ করা সম্ভব নয়, এমন যুক্তি দেখিয়ে সম্প্রচার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে গত বৃহস্পতিবার থেকে বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ রয়েছে। অবশ্য ভারতীয় চ্যানেল সম্প্রচার শুধু আমাদের দেশেই বন্ধ করা হয়নি, পাকিস্তান ও নেপাল অনেক আগেই বন্ধ করেছে। চীনের সাথে দ্বন্দ্বের জেরে চীনও ভারতীয় চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ করেছে। এ ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশেও তা বন্ধ করা হয়েছে। মূলত আমাদের দেশে বিদেশি পণ্যের ব্যাপক প্রসার রোধ এবং দেশীয় পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, একেবারে ঢালাওভাবে বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করার চেয়ে যেসব শিক্ষণীয় চ্যানেল, যা আমাদের দেশের জন্য ক্ষতিকর নয়, সেগুলো রেখে ক্ষতিকর চ্যানেলগুলো চিহ্নিত করে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো।

বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেল বিশেষ করে কলকাতাভিত্তিক বাংলা চ্যানেলগুলোর সিরিয়ালসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান, যেগুলো আমাদের দেশের শিল্প-সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার পরিপন্থী এবং পরিবার ও সমাজে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, সেসব বন্ধের দাবী দীর্ঘদিনের। এসব চ্যানেলের সিরিয়ালগুলোর গল্পে পারিবারিক ও সামাজিক ইতিবাচক দিকের চেয়ে নেতিবাচক দিকগুলো বেশি তুলে ধরা হয়। পারিবারিক কোন্দল, কূটচাল, পরকীয়া, অনৈতিক সম্পর্ক, লোভ-লালসা, নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্রই সিয়ালগুলোতে বেশি প্রাধান্য পায়। এসব একশ্রেণীর দর্শককে বেশি আকর্ষণ করে এবং এর দূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া মানুষের উপর পড়ছে। এমনকি হিন্দি ও বাংলা অপরাধবিষয়ক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে বেশ কিছু খুনের ঘটনা ঘটেছে, যা অপরাধীরা স্বীকার করেছে। কলকাতার বাংলা সিরিয়ালে পরকীয়া, অনৈতিক সম্পর্ক ও কূটচালের গল্প দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার নজিরও রয়েছে। সিরিয়ালে অভিনেত্রীর পোশাকের অনুকরণে ঈদের সময় পোশাক কিনে না দেয়ার কারণে কিশোরীর আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া ভারতীয় চ্যানেলগুলোর নাটকে তাদের ধর্মীয় বিষয় এবং সংস্কৃতি এমনভাবে তুলে ধারা হয়, যার প্রভাব আমাদের দর্শকের ওপরও পড়ে। অধিকাংশ সিরিয়ালের নেতিবাচক গল্পের অনুকরণ আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে হতে দেখা যায়। অথচ সত্তুর দশকের শেষে এবং আশি ও নব্বই দশকে আমাদের দেশের একমাত্র চ্যানেল বিটিভি দেখার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মুখিয়ে থাকত। সকাল সন্ধ্যা, ভঙনের শব্দ শুনি, শুকতারা, সংশপ্তক, কোথাও কেউ নেই, এইসব দিনরাত্রির মতো অসম্ভব জনপ্রিয় নাটক উপভোগ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সীমান্তের কাছাকাছি এন্টেনা লাগিয়ে বিটিভি দেখত। আমাদের এসব ধারাবাহিকের কাহিনী যেমন ছিল ইতিবাচক ও জীবনঘনিষ্ট, তেমনি ছিল বিনোদন ও শিক্ষার মাধ্যম। এসব ধারাবাহিকে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় রীতিনীতি ও সংস্কৃতি অসাধারণভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। তার প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের দর্শকের ওপর পড়ে এবং তারা আকৃষ্ট হয়। তবে স্যাটেলাইট বা আকাশ সংস্কৃতির ব্যাপক সম্প্রসারণের কারণে ভারতীয় ও বিদেশি চ্যানেলের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমাদের দেশেও সরকারি চ্যানেল বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডের বাইরে প্রায় ৩৫টির মতো বেসরকারি চ্যানেল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব চ্যানেলের মধ্যে সংবাদভিত্তিক, সঙ্গীত, খেলাধুলা, শিশুতোষ এবং মিশ্র অনুষ্ঠানের চ্যানেল রয়েছে। তবে এসব চ্যানেল শুরুর দিকে দর্শক আকৃষ্ট করতে পারলেও অনুষ্ঠানের মানের কারণে তা ক্রমাবনতির দিকে ধাবিত। আকাশ সংস্কৃতির উন্মুক্ততার কারণে কলকাতাভিত্তিক বাংলা চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার শুরু হলে এবং তাদের নাটকের গল্পের টানাপড়েন ও নেতিবাচক দিকগুলো অল্প সময়ে আমাদের দর্শককে আকৃষ্ট করে। এ নিয়ে সুশীল সমাজের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হয় এবং তারা এসব চ্যানেল বন্ধ করার দাবী জানায়। তবে ভারতীয় এবং বিদেশি এসব চ্যানেলের মধ্যে দেখার এবং জানার মতো বেশ কিছু চ্যানেলও দর্শকপ্রিয় হয়ে উঠে। জিওগ্রাফি, ডিসকভারি, অ্যানিমেল প্লানেট নামের চ্যানেলগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এখন ভারতীয় ও বিদেশি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধের কারণে এ চ্যানেলগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। বলা বাহুল্য, আকাশ সংস্কৃতির এ যুগে চিরস্থায়ীভাবে কোনো কিছুই বন্ধ বা আটকে রাখা যায় না। ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যম যেমন ইউটিউব, নেটফ্লিক্সসহ নানা অ্যাপসের মাধ্যমে দর্শক এখন নতুন নতুন সিনেমা ও বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট দেখতে পাচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া ভারতীয় ও বিদেশী চ্যানেলগুলোও এখন ইউটিউবে তাদের অনুষ্ঠান প্রচার করছে। এসব অনুষ্ঠানেও বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলোও ইউটিউবে তাদের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। ফলে চ্যানেল বন্ধ হলেও অনুষ্ঠান চালানোর বিকল্প পথ এখন উন্মুক্ত।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আমাদের পরিবার, সমাজ ও সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর ভারতীয় ও বিদেশি চ্যানেল বন্ধের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। তবে এক্ষেত্রে যেসব চ্যানেলের মাধ্যমে অজানাকে জানা ও শেখার বিষয় রয়েছে, সেগুলো চালু রাখা দরকার। অন্যদিকে, অনুষ্ঠানের মান উন্নয়নের মাধ্যমে দর্শক আকৃষ্ট করার সুযোগ আমাদের দেশীয় চ্যানেলগুলোর সামনে এসেছে। এ সুযোগ চ্যানেলগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারতীয় চ্যানেলগুলোর একটি-দুটি সিরিয়াল এবং রিয়েলিটি শো-ই দর্শক মাতিয়ে রেখেছে। আমাদের দেশের চ্যানেল কর্তৃপক্ষেরও উচিৎ আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে দর্শক আকৃষ্ট করে এমন অনুষ্ঠান নির্মাণ করা। এখন এ ধরনের অনুষ্ঠান নির্মাণ করা অসম্ভব কিছু নয়। কারণ, আমাদের দেশের যেসব মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠান ভারতীয় ও বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিত, তারা এখন দেশীয় চ্যানেলে ভালো মানের অনুষ্ঠান নির্মাণে বিজ্ঞাপন ও বাজেট দিয়ে সহযোগিতা করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। ফলে চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে দর্শক আকৃষ্ট করার মতো অনুষ্ঠান নির্মাণে উদ্যোগী হতে হবে। দেশীয় শিল্প-সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে ধারণ করে উন্নত মানের অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে হবে। ইতোমধ্যে আমাদের দেশে বিভিন্ন চ্যানেলে একাধিক তুর্কি সিরিয়াল ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এসব সিরিয়ালের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং শালীন পারিবারিক গল্প দর্শকের কাছে নির্মল বিনোদনের উৎস হয়ে উঠেছে। আমাদের নির্মাতারাও দেশীয় প্রেক্ষাপটে যুথবদ্ধ গল্প ও কনটেন্ট নিয়ে অনুষ্ঠান নির্মাণ করার সক্ষমতা রাখেন। এজন্য চ্যানেলগুলোর কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
Md Helal Karim ৩ অক্টোবর, ২০২১, ৯:৪০ এএম says : 0
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ খুব খুশি হয়েছে। এই কাজটা আরো আগে করা উচিত ছিল। এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হোক।
Total Reply(0)
MD Sifat Sikdar ৪ অক্টোবর, ২০২১, ৬:০৩ পিএম says : 0
Indian sporting channel,geography,discovery is very good.....These channel shoould be released
Total Reply(0)
Anik ৫ অক্টোবর, ২০২১, ১২:২৪ এএম says : 0
স্টার জলসা এবং জি বাংলা চালু রাখা হোক
Total Reply(0)
Shahin Alom surya ৫ অক্টোবর, ২০২১, ৩:২০ পিএম says : 0
ঐ চ্যানেলগুলো অনেক আগে স্থায়ীভাবে বন্ধ করা উচিত ছিল কারণ চ্যানেলগুলো আমাদের দেশের আভ্যন্তরীণ সামাজিক কার্যকলাপে অনেক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে তাই আমি সরকারকে অনুরোধ করবো এই চ্যানেলগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হোক
Total Reply(0)
কামাল পারভেজ পাভেল ৯ অক্টোবর, ২০২১, ১:৪৮ এএম says : 0
খুব ভাল সিন্ধান্ত নিয়েছে সরকার।স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হোক এসব ক্ষতিকর চ্যানেল। খুব ভাল সিন্ধান্ত নিয়েছে সরকার।স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়া হোক এসব ক্ষতিকর চ্যানেল।
Total Reply(0)
Md.Obaidur Rahman ১১ অক্টোবর, ২০২১, ১২:৩১ পিএম says : 0
আমি মনে করি,সরকার বিদেশি চ্যালেন বন্ধ করে দিয়ে অনেক ভালো করেছে,,কিন্তু এই চ্যালেন স্হায়ী ভাবে বন্ধ করে লাভ কি,,,এই ডিজিটাল যুগে এসব বন্ধ করলেও দেখার পদ্ধতি আছে,,,,আমার মতে চ্যালেন গুলো বিজ্ঞাপনহীন ও ক্লিনফিড বাস্তবায়ন হোক,,,এটা করতে পারলে চ্যালেন গুলো সম্প্রচার করতে দেওয়া হোক,,,কারণ কয়েকটা চ্যালেনের জন্য ১৫০ টাকা করে দিতে হয়,,এ কারণে অনেকে ডিস লাইন কেটে দিচ্ছে, আর কেউ কোনো চ্যালেন দেখছেন না,,,কারণ বাংলাদেশর চ্যালেন গুলোতে বিজ্ঞাপন দিয়ে ভরা, আর সারাক্ষণ খবর দেখতে হয়, বিনোদন বলতে কোনো চ্যালেন নেই,,, আমরা আশা করি আবার সব চ্যালেন চালু হবে।।
Total Reply(0)
তাহমিনা ১২ অক্টোবর, ২০২১, ৮:৪২ পিএম says : 0
আমি চাই খুব তাড়াতাড়ি ইন্ডিয়ান সব চ্যানেল সম্প্রচার হোক আগের মত,,কর্তপক্ষ যেনো বিষয় টি দেখে,,আমাদের স্টার জলসা, জি বাংলা কালার্স বাংলা ছাড়া টিভি শুন্য মনে হচ্ছে,বাংলাদেশি কুনো চ্যানেলে সুন্দর সিরিয়াল বা শো দেওয়া হয়না,,তাই দয়া করে দর্শকদের চাওয়া ভিত্তি করে, খুব তাড়াতাড়ি আপ্নারা চ্যানেলগুলা দিন,,,
Total Reply(0)
জুয়েল ৩০ নভেম্বর, ২০২১, ১:৫৫ পিএম says : 0
ভারতীয় ও বিদেশি বিনোদন চ্যানেল বন্ধ হোক, কিন্তু খবর, ডকমেন্টারি চ্যানেল চালু থাক
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন