শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

প্রিন্ট বনাম ডিজিটাল

ডা. অপূর্ব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০২১, ১২:১০ এএম

বইয়ের পড়া বনাম স্ক্রিনে পড়া। অথবা বইতে পড়তে পড়তে ভাবনায় দেখা, নাকি দেখতে দেখতে ভাবনায় লেখার মতো আঁকা, কোনটি মনে থাকে বেশি। প্রিন্ট ভার্সেস ডিজিটাল, পাতার মনিটর ভার্সেস পিক্সেল মনিটর। যদিও দুটোই কমিউনিকেশন, কিন্তু কোনটি শক্তিশালী, অথবা কোনটি আমাদের মনে থাকে বেশি, অথবা কোনটি আমাদের মস্তিষ্কের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটাই প্রশ্ন। যুগ ডিজিটাল, কিন্তু সে তুলনায় আমাদের মস্তিষ্ক কি এখনো এনালগ?

মেমোরি এবং শেখা হাত ধরাধরি করে চলে। একটির ভূমিকা আরেকটির ওপর প্রভাব ফেলে। কোনো কিছু দেখতে, পড়তে গিয়ে তাই যেমন টুলস ব্যবহার করি, সেটাও আমাদের শেখার ফলাফলে ইফেক্ট করে।

আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর প্রতিটির আলাদা এবং নির্দিষ্ট একটি কাজ আছে, রোল প্লে আছে। যখন আমরা শুধু পড়ছি, আমরা চোখ দিয়ে প্রিন্টে সেটা দেখছি, মাথার ভেতর তার ছবি আঁকছি। আবার আমরা কিছু যখন দেখছি মনিটরে এবং সাথে শুনছি, সেটাকে মস্তিষ্কে ধারণ করছি। দুটো কিন্তু এক নয়। এমনকি আমরা যখন কলম দিয়ে লিখছি এবং টাইপ করছি, দুটোতে শরীরের একই অংশ আঙ্গুল ভিন্নভাবে ব্যবহার করছি। একটিতে স্ক্রিনে চাপ দিচ্ছি, আরেকটিতে একটি বস্তু, কলম বা পেন্সিল ঘোরাচ্ছি। দুটো মস্তিষ্কে দুইভাবে যাচ্ছে।

একটি খবর যখন পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ি এবং একই পত্রিকা বা খবর স্ক্রিনে পড়ি, দুটো কি একইভাবে মস্তিষ্কে ক্রিয়া করে? অনেক প্রশ্ন থেকে যায়। এখন আমরা প্রতিনিয়ত তিনটি মাধ্যমে আমাদের চারপাশকে জড়ো করি। প্রিন্ট, অডিয়ো এবং ভিডিয়ো। একটু কমিয়ে আনলে প্রিন্ট ভার্সেস ডিজিটাল। প্রিন্টকে এনালগ বললে এনালগ ভার্সেস ডিজিটাল। ভবিষ্যৎ কোনটি ডমিনেট করবে বা সময়ে কোনটি টিকে থাকবে, সে উত্তরের চেয়ে কোনটি কীভাবে আমাদের চিন্তা, বোধ, কমিউনিকেশন এবং শেখায় প্রভাব ফেলে, তাকে বুঝতে পারাটা আরও বেশি জরুরি।

প্রথমে আসি আমরা যখন কোনো কিছু কাগজে বা প্রিন্টে পড়ি এবং তারই একটি রূপ অডিয়ো-ভিডিয়ো ফরমেটে স্ক্রিনে দেখি, দুটোই আমাদের শেখা বা চিন্তার পদ্ধতি! যখন আমরা কোন টেক্সট পড়ি- তার একটি মেন্টাল মেকআপ তৈরি করি আমাদের মস্তিষ্কে। যে চিন্তাটি পড়ছি, তাকে প্রথমে আমাদের মস্তিষ্কে বিনির্মাণ করি। তারপর পূর্ব থেকে থাকা আমাদের ধারণাটি সেটির সাথে মুখোমুখি হয়। আমাদের চিন্তা পদ্ধতি অনুযায়ী তখন বিনির্মিত পড়াটির বোধটিকে আগের বুঝের সাথে মিলিয়ে আরেকবার বিনির্মাণের দিকে যাই এবং এ ক্ষেত্রে আগের বুঝ এবং আমাদের বায়াস্ডনেস, মাইন্ড সেট, বিলিফ, সোর্সের সাথে আমাদের আন্তঃ সম্পর্কে অনেকগুলো ফ্যাক্টর ঠিক করে কোনটি আমরা রাখবো, কোনটি আমরা ফেলে দেব, কোনটির গন্ধ আমার পরিচিত, কোন ঘটনাটি আমার পূর্ব ঘটনার সাথে খানিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই যে প্রক্রিয়াটির দীর্ঘ একটি চেইন, একটি ঘটনার সূত্র ধরে আরেকটি বিনির্মাণের সুতো, দুয়ে মিলে আমাদের স্মৃতিতে, চিন্তায়, বোধে এবং শেখায়, প্রিন্টে কিছু পড়া বেশি প্রভাব ফেলে, বেশি মনে থাকে, মূল কাঠামোটি ধরতে পারি এবং স্থায়িত্ব বাড়ে।

তাহলে ডিজিটাল ফরম্যাটে যখন দেখি, শুনি, অনুভব করি, সেখানে কি একই প্রক্রিয়া ঘটে? উত্তর, না। প্রিন্টে আমাদের নির্মাণ করতে হয় চিন্তাটি, অর্থটি, ভাবটি, রংটি, এমন কি অনুভব যেটা পড়ছি, সেটাকে অনুভবের ভাষায় অনুবাদ করতে হয়। কিন্তু ডিজিটালে সেটি নির্মিত হয়ে আসে। অবশ্যই সেই নির্মাণেরও আরেকটি বিনির্মাণ হয় আমাদের চিন্তায়। কিন্তু যেটিকে প্রস্তুত করে নিজের চিন্তায় নির্মাণ করতে হয় আর যেটি নির্মিত হয়ে আসে, দুটো আমাদের শেখা, মনে থাকা, বোধগম্যতার গভীরতায় প্রভাব ফেলে। প্রিন্ট করতে করতে শেখে, ডিজিটাল ডাইরেক্ট ধরিয়ে দেয়। আপাত দৃষ্টিতে ডিজিটাল আয়েশি মনে হয়, সরাসরি প্রাপ্তি বেশি সহজ শুনতে মনে হলেও এটি বরং চিন্তাকে অগভীর করে দেয়। খোঁড়া জিনিস একসাথে পাওয়া আর খুঁড়তে খুঁড়তে পাওয়া এক নয়।

সা¤প্রতিক প্যানডেমিকে ক্লাস রুম টিচিং এবং রিসিভিং দুটোই কমে গিয়ে সামনে এসেছে ডিজিটাল টিচিং, পরিস্থিতির রিসিভিং এবং মেটেরিয়াল। পরিস্থিতির বিকল্প আর বেস্ট ছিল না। টেক্সট ফরম্যাটে পড়ার মেটেরিয়াল যেমন কমেছে, তেমনি সেটার লাইভ ফরম্যাট ফেস টু ফেস ইন্টার‌্যাকশনেও এসেছে ভিন্ন মাত্রা। দুটোর মাত্রার একসাথে পরিবর্তন এবং এফেক্ট হয়তো সাময়িক, কিন্তু তার লঙ টার্ম কন্সিকুয়েন্স অনেক দিনের।

সা¤প্রতিক আন্ডারগ্রাডুয়েট লেভেলের ইউনি স্টুডেন্টদের উপর এক গবেষণায় দেখা গেছে ডিজিটাল ফরম্যাটে পাঠ গ্রহণ এবং পরীক্ষার রেজাল্টে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করেছে, কিন্তু সেটি পূর্বের প্রিন্ট ফরম্যাটের পাঠের ফলাফলের মানের চেয়ে কম। সংখ্যায় ব্যাপ্তি বেড়েছে, কিন্তু মানে অগভীর হয়েছে। কারণ, দুটো পদ্ধতি দুইভাবে মস্তিষ্কে ইমপ্যাক্ট করছে। জিনিস বেশি মানুষের বোধগম্যের এবং সহজলভ্য হচ্ছে সত্য, কিন্তু আরেকটিকে তার অগভীর এবং মানগত মজবুতি কমে যাচ্ছে।

এর কারণ পরীক্ষার রেজাল্ট নির্ভর করে মেমোরি, কন্সেপশন ক্লিয়ার এবং রিপিটেশনের উপর। মেটেরিয়ালস ডিজিটাল হলে শ্যালো কনসেন্ট্রেশন, ডিস্ট্রাকশন এবং কম রিপিটেশন হচ্ছে। পেপার মেটেরিয়ালে তিনটায় বিপরীত এডভান্টেজ পাচ্ছে। ফলে স্টুডেন্টদের মধ্যে আইডিয়াস এবং পার্সেপশন ধরে রাখায় জড়তা দেখা দিচ্ছে। আর তাতে রেজাল্টে ইমপ্যাক্ট ফেলছে।

পাশাপাশি এটাও দেখা গেছে ডিজিটাল ফরম্যাট, বিশেষ করে টেক্সট মেটেরিয়ালের চেয়ে অডিয়ো বা লিসেনিং ফরম্যাটে কিংবা ভিজুয়াল বা ভিডিয়ো ফরমেটে একই কনটেন্টের সাথে অনেক বেশি ইন্টার কানেকশন, ডাইভার্সিটি, ডাইনামিক ওয়েতে কোনটেন্স এ নিজের স্পেস পায়, যেটা তাকে আবজর্ব করায় দ্রুত, যা পেপার ফরম্যাট কিংবা রাইডিং ফরম্যাটে মোর মেন্টাল কনসেন্ট্রেশন দিয়ে অর্জন করতে হয়। তখন দেখা গেছে কমফোর্ট ভার্সেস কনসেন্ট্রেশন স্টুডেন্টরা কমফোর্টকে বেছে নিচ্ছে। এটা একই সাথে কানেকশন রিদম বাড়ালেও যেটা বাড়াচ্ছে সেটা শর্ট মেমোরি, লেস পারসেপ্টিভ এবং মাইন্ড সেট মিস্টেক তৈরি করছে।

ডিজিটাল হোক আর প্রিন্ট হোক, শিক্ষা থেকে রাজনীতি, সমাজ থেকে ব্যক্তিকে জীবন, সম্পর্ক থেকে গভীরতা, সবখানেই কম বেশি প্রভাব ফেলছে এবং ফেলবে। যে কোনো পরিবর্তন একইসাথে পূর্বের কিছু অর্জনকে যেমন উড়িয়ে দেয়, বিলোপ করে দেয়, তেমনি এমন অনেক কিছু নতুনেরও শুরু করে, যা পূর্বের অর্জনে কিংবা অভ্যাসে সম্ভব ছিল না। দুয়ে মিলে সময় এগিয়ে যায় পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং পরিবর্ধনের খেলায়।

লেখক: চিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক
opurbo.chowdhury@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন