ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা অপার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ব্লু ইকোনমির দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে। তাদের সাফল্যও চমৎকার ও উৎসাহজনক। এ প্রসঙ্গে চীন, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশের কথা উল্লেখ করা যায়। এসব দেশ ব্লু ইকোনমি কাজে লাগিয়ে তাদের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। বাংলাদেশে ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা কোনো দেশের চেয়েই ন্যূন নয়। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধের অবসান হওয়ায় সমুদ্রে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এলাকা সম্প্রসারিত হয়েছে। এই বিশাল এলাকায় সমুদ্রসম্পদ আহরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগ কার্যকর করতে পারলে দেশের উন্নয়ন দ্রুতায়িত হতে পারে। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমাবিরোধের নিষ্পত্তি হওয়ার পরও অনেক দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। কিন্তু সমুদ্রসম্পদ আহরণের মাধ্যমে ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা কাজে লাগানোর দৃশ্যগ্রাহ্য তেমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। আজ পর্যন্ত সমুদ্রসম্পদ জরিপের কোনো ব্যাপকভিত্তিক কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। সমুদ্রে কী ধরনের সম্পদ আছে, তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কতটুকু সেই জরিপ না হলে সম্পদ আহরণে পদক্ষেপ গ্রহণ বা বিনিয়োগ কিভাবে সম্ভবপর হতে পারে? সর্বাগ্রে তাই প্রয়োজন অনুপুঙ্খ জরিপের। পৃথিবীর বিভিন্ন উপসাগরে জরিপ হয়েছে, জরিপে সম্পদের যে হদিস বা বিবরণ পাওয়া গেছে, তাতে ধরে নেয় যায়, মৎস্যসম্পদ ছাড়াও বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাসসহ বিভিন্ন খনিজসম্পদের ব্যাপক মজুদ রয়েছে। মৎস্যসম্পদের কথা আমরা জানি। বলা হয়, বঙ্গোপসাগর মৎস্যসম্পদের অনিঃশেষ ভা-ার। প্রতি বছর সাগর থেকে বিপুল পরিমাণ মাছ আহরণ করা হলেও সম্ভাবনার তুলনায় তা খুবই নগণ্য। অর্থনৈতিক জোন উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল দীর্ঘ হলেও বাংলাদেশের জেলেরা মাছ ধরে মাত্র ৬০ কিলোমিটার এলাকায়। জানা যায়, একমাত্র টুনা মাছ আহরণ করেই বাংলাদেশ বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। দেখা গেছে, জেলেরা সাধারণত ২০ মিটার গভীরে যেতে পারে। অথচ টুনা মাছ ধরতে ১০০ মিটার গভীরে যেতে হয়। শুধু টুনা নয়, সমুদ্রে আরো বহুবিধ মাছ রয়েছে এবং এই সঙ্গে আছে শৈবাল, কোরাল, কাঁকড়া ইত্যাদি।
বিশ্বের সব উপসাগরেই তেল-গ্যাস পাওয়া গেছে। বঙ্গোপসাগরেও তেল-গ্যাস আছে, একথা বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন ধরে বলে আসছেন। এমন কথাও অতীতে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরে তেলের একটি দীর্ঘ নদী আছে, যার গভীরতা বাংলাদেশ অংশে সবচেয়ে বেশি। ভারত ও মিয়ানমার ইতোমধ্যে গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে। তেল পাওয়ার ব্যাপারে তারা আশাবাদী। বাংলাদেশের এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতিই নেই। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে এক ধরনের চেষ্টা সক্রিয় আছে বটে; কিন্তু তার শুভসূচনা এখনো হয়নি। ভারত ও মিয়ানমার এক্ষেত্রে অনেকদূর এগিয়ে গেলেও আমরা পিছিয়ে আছি। আমাদের এই অপারগতার হেতু কোথায় সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে আনা আবশ্যক। বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গোপসাগরের তলদেশের গঠন-প্রকৃতি অনুযায়ী শুধু তেল-গ্যাস নয়, রুটাইল, ইলমেটাইট, গার্নেট, মোনাজাইট, ম্যাগনোটাইট, কায়ানাইট, জিরকন ইত্যাদি মূল্যবান খনিজসম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব বহু মূল্যবান সম্পদ পাওয়া গেলে দেশের অর্থনীতির বর্তমান চেহারা অল্পদিনের মধ্যেই আমূল পাল্টে যেতে পারে। একথা বলাই বাহুল্য, বিশ্বের ভূ-উপরিস্থিত সম্পদ দিন দিন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। মৎস্যসম্পদই হোক কিংবা তেল-গ্যাসের মতো খনিজসম্পদই হোক, সবই দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। খাদ্যশস্য উৎপাদনও নানা কারণে আগামীতে হ্রাস পাবে। এমতাবস্থায় সমুদ্রকে খাদ্য ও সম্পদের অকর্ষিত বিশাল ভা-ার হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ভবিষ্যতের প্রয়োজনের তাকিদেই সমুদ্রসম্পদ আহরণে উদ্যোগ ও কার্যক্রম বাড়ছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, চীন, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ এ ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী অবস্থানে রয়েছে। ব্লু ইকোনমিতে জোর দিয়ে তারা তাদের অর্থনীতিতে নতুন গতিবেগ সঞ্চার করতে সমর্থ হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকেও সাগরের দিকে অধিক মনোনিবেশ করতে হবে। অধিক জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা আগামীতে বড় রকমের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। খনিজসম্পদের মধ্যে আমরা কেবল গ্যাসই পেয়েছি এবং তা কাজে লাগাতে পারছি। সেই গ্যাসের মজুদও কমছে। বিদ্যমান মজুদে আরো কিছুদিন হয়তো চলবে। যদি আর গ্যাস পাওয়া না যায়, তাহলে ‘গ্যাস-যুগের’ অবসান হবে। তেলের সম্ভাবনার কথা বলা হলেও তেমন খোঁজ নেই। হরিপুরে তেল পাওয়া গেলেও তার উত্তোলন হয়নি। তেলের আর কোনো সন্ধানও পাওয়া যায়নি। ক্রমশ জ্বালানি নিরাপত্তার আশা ধূসর হতে যাচ্ছে। কাজেই, আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা, জ্বালানিনিরাপত্তা, অর্থনীতির বিকাশ ও উন্নয়ন-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হলে সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের বিকল্প নেই। এজন্য দ্রুত সম্ভব সমুদ্রসম্পদ জরিপের কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। এরপর সন্ধানপ্রাপ্ত সম্পদের সম্ভাব্য পরিমাণ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়ে আরোহণের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সম্পদের নিরাপত্তায় নিশ্চিত করার ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে। সমুদ্রসীমার সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে ব্লু ইকোনমি গড়ে তোলা ও তার বিকাশ সাধন করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী ও সক্ষম নৌবাহিনী গড়ে তোলার আবশ্যকতা প্রশ্নাতীত। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই ব্লু ইকোনমির প্রতি জোর দিতে হবে। এর জন্য যা কিছু করণীয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তা করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন